(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সিভি আনন্দ বোস এবং শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
শান্তিনিকেতন উইনেস্কোর তরফে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের তকমা পাওয়ায় বিশ্বভারতী যে স্বীকৃতি-ফলক তৈরি করেছে তা নিয়ে বিতর্ক থামছে না। এ বার আসরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। ফলকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম না-থাকা নিয়ে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে বোলপুরে শুক্রবার থেকে আন্দোলনেও নেমেছে শাসকদল তৃণমূল। প্রতিবাদের পথেই হেঁটেছেন রাজ্যপাল তথা বিশ্বভারতীর রেক্টর সিভি আনন্দ বোসও। ফলকে রবীন্দ্রনাথের নাম কেন নেই, সে ব্যাপারে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছেন তিনি। সেই ফলক-বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সুরেই গলা মেলালেন শুভেন্দু। সাম্প্রতিক অতীতে কোনও বিষয় নিয়েই এমন মিল দেখা যায়নি। বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে ‘ইগো’ ঝেড়ে ফেলে ফলকে কবিগুরুর নাম উল্লেখ করার পরামর্শ দিলেন বিরোধী দলনেতা।
শান্তিনিকেতনকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করার পর থেকেই অভিযোগ উঠছে, এই কাজের জন্য উপাচার্য নিজে কৃতিত্ব নিতে চান তো বটেই, আচার্য হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাও তিনি তুলে ধরতে চান। এই আবহে সম্প্রতি বিশ্বভারতীর তরফে উপাসনা গৃহ, ছাতিমতলা এবং রবীন্দ্রভবনের উত্তরায়ণের সামনে শ্বেতপাথরের ফলক বসানো হয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’। তার ঠিক নীচে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিদ্যুতের নাম রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম নেই। এই নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত। উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের কাছে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট ও শান্তিনিকেতন আশ্রম সঙ্ঘ। একই ভাবে বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশনের (ভিবিইউএফএ) তরফেও প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ও রাজ্যপালকে ই-মেল করে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ফলক-কাণ্ড নিয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে।
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কড়া সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বিতর্কিত ফলক সরিয়ে দেওয়ার জন্য ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন কেন্দ্রকেও। রাজভবন সূত্রে খবর, রাজ্যপালও বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। তা নজরও কেড়েছিল বিভিন্ন মহলের। কারণ, সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে, নবান্ন এবং রাজভবন কথায়-কথায় পরস্পরের বিরুদ্ধে তাল ঠোকে। মুখোমুখি সৌজন্যেও কখনও কোনও ঘাটতি দেখা না গেলেও প্রকাশ্যেই একে অপরের সমালোচনা করতে দেখা গিয়েছে রাজ্যের দুই শীর্ষ প্রতিষ্ঠানকে। শিক্ষা থেকে আইনশৃঙ্খলা— নানা বিষয়ে নবান্ন তথা রাজ্য প্রশাসনের সমালোচনা করেছে রাজভবন। কিন্তু ফলক-বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকেই ‘সমর্থন’ করতে দেখা যায় রাজ্যপাল বোসকে।
কিন্তু শুভেন্দুর এ ভাবে মমতার ‘পথে হাঁটা’ একেবারেই বিরল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর এমনটা ঘটেছে কি না, তা মনেও করতে পারছেন না কেউ। কিছু দিন আগে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে জমি নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। সেই সময় মমতা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। উল্টো দিকে, কার্যত বিশ্বভারতী তথা উপাচার্যের পাশে দাঁড়িয়ে অমর্ত্যের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে দেখা গিয়েছিল শুভেন্দু তথা গোটা বিজেপি দলকেই। সেই শুভেন্দুই ফলক-বিতর্ক নিয়ে বললেন, ‘‘এটা তৃণমূল বলেছে বলে আমি বলব না, তা তো হতে পারে না। এই ফলক নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। ভিসি (উপাচার্য বিদ্যুৎ) যদি এই ফলকটি করে থাকেন, তা হলে সংশোধন করুন।’’
অমর্ত্য-বিতর্কের সময় থেকেই উপাচার্য বিদ্যুতের ‘বিজেপি-ঘেঁষা মনোভাব’ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝ়ড় উঠেছিল। বিজেপি নেতা অনুপম হাজরাই সেই সময় মন্তব্য করেছিলেন যে, উপাচার্য নিজেকে ‘বিজেপি’ বলে প্রমাণ করতেই এ সব করছেন। সেই বিদ্যুৎকে নিশানা করেই বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘এটা নিয়ে উপাচার্যের এত ইগোর কী আছে? এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়। কতগুলি বিষয়ে বাংলা ও বাঙালির ইমোশান আছে, রেসপেক্ট আছে। তা হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁদের সম্মান দেওয়ার বিষয়ে কোনও রকম জেদাজেদি থাকতে পারে না।’’
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতার নির্দেশে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ছবি বুকে নিয়ে ধর্না কর্মসূচি শুরু করেছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। মুখ্যমন্ত্রীও শনিবার এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, ‘‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে যে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র বিশ্বভারতীকে তৈরি করেছিলেন, বর্তমানে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। কিন্তু বর্তমান কর্তৃপক্ষ সেই স্থানের স্মারক হিসাবে যে ফলকটি বসিয়েছেন, তাতে উপাচার্যেরও নাম রয়েছে, বাদ কেবল গুরুদেবের নাম!’’ মমতার বার্তা, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ, এই অহংকারী, আত্মপ্রদর্শনবাদের নমুনাটিকে সরিয়ে দেওয়া হোক এবং গুরুদেবকে যাতে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেশ জানাতে পারে, তার ব্যবস্থা হোক।’’ ধর্না মঞ্চ থেকেও উপাচার্যকে নিশানা করেছেন তৃণমূল নেতারা। বিদ্যুৎকে তাঁর বাড়ি ও বোলপুর থেকে ‘বার করে দেওয়ার’ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন শাসকদলের নেতা গদাধর হাজরা। সেই মঞ্চেই উপস্থিত ছিলেন রামপুরহাটের বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, বোলপুরের সাংসদ অসিত মাল। তা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এর পর রবিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে চিঠি দিয়েছেন বিদ্যুৎ। মমতার উদ্দেশে বিদ্যুতের মন্তব্য, ‘‘আপনার স্তাবকেরা যা বলেন, আপনি তা-ই বিশ্বাস করেন। আপনি এখনও কান দিয়েই দেখেন!’’ ফলক সরানো নিয়েও উপাচার্য চিঠিতে জানিয়েছেন, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-এর নির্দেশ মতো ফলক তৈরি হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যেই তা সকলে দেখতে পাবেন।
বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের নাম বাদ যাওয়ায় ক্ষুব্ধ আশ্রমিক থেকে শুরু করে প্রাক্তনী ও বিশ্বভারতীর শিক্ষকদের একাংশ। এমন ঘটনা অতীতে কোনও দিন ঘটেনি বলেও বিশ্বভারতীর অনেকের দাবি। বিশ্বভারতীর প্রথা অনুযায়ী কোনও উদ্বোধনী ফলক বা স্বীকৃতি ফলকে সাধারণত কারও নাম উল্লেখ করা হয় না। ঠাকুর পরিবারের সদস্য তথা প্রবীণ আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুর আক্ষেপ করে আগেই বলেছেন, “বর্তমান উপাচার্য বিশ্বভারতীর হর্তা-কর্তা-বিধাতা হয়ে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলে কেউ ছিলেন, আজ বোধহয় তাঁরা ভুলে গিয়েছেন। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি এখানে।’’ আর এক আশ্রমিক তথা প্রাক্তনী অনিল কোনারেরও মন্তব্য, “৭০ বছরে আমি কোনও উপাচার্যের নামের কোনও ফলক এখানে দেখিনি। এই রীতি এখানে চলে না। উনি নিজের মতো করে একের পর এক ঐতিহ্য ভেঙে চলেছেন।’’
বিশ্বভারতীর শিক্ষক সংগঠন ভিবিইউএফএ-র সভাপতি সুদীপ্ত ভট্টাচার্যও আগে দাবি করেছেন, যেখানে যেখানে ফলক লাগানো হয়েছে, তার মালিকানা হয় শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের, নয় তো পূর্ত দফতরের। তাই ফলক বসানোর কোনও আইনি অধিকার উপাচার্যের নেই। তিনি বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথকে মুছে দিয়ে নিজের নামে এই প্রচার করার ব্যাপারটি নিয়ে আইনি পরামর্শ করছি। যে ভাবে আচার্যের নাম ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে তাঁর সম্মতি নেওয়া হয়েছে কি না, তা-ও আমরা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জানতে চাইব।’’