তাপস রায় এবং বিশ্বরূপ দে। —ফাইল চিত্র ।
এক সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উত্তর কলকাতার সমস্ত আপদ-বিপদে ছুটে বেড়াতেন একসঙ্গে। একসঙ্গে চলত দলের মিটিং, মিছিল, আলোচনা, আড্ডা। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানেই সেই সম্পর্কে ছেদ পড়েছে। ভিন্ন দলীয় মতাদর্শের কারণে দূরত্ব বেড়েছে সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া তাপস রায় এবং তৃণমূল কাউন্সিলর বিশ্বরূপ দে-র। মঙ্গলবার সকালে বৌবাজার এলাকার ভেঙে পড়ার বাড়ির কাছে পরস্পরের দেখা হলেও কথা হল না তাঁদের। এড়িয়েই গেলেন একে অপরকে। তবে কেউ কারও প্রতি বিরূপ মন্তব্য না করে এ-ও বুঝিয়েও দিলেন, সম্পর্কের মধ্যে দলীয় পাঁচিল উঠলেও একের অপরের প্রতি সমীহ রয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে বৌবাজারের রামকানাই অধিকারী লেনের একটি পুরনো বাড়ির দেওয়াল সমেত ঘরের একাংশ আচমকা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বাসিন্দাদের অভিযোগ শুনতে এবং দুর্ঘটনাস্থল দেখতে মঙ্গলবার বেলার দিকে সেখানে গিয়েছিলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা তথা লোকসভায় উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থী তাপস। অন্য দিকে, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটি কলকাতার ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে, যার কাউন্সিলর বিশ্বরূপ। দুর্ঘটনার পর থেকেই তিনি এলাকায় ছিলেন। তাপস যখন ওই বাড়িটির কাছে পৌঁছন, তখন কিছুটা দূরেই চেয়ার পেতে বসেছিলেন বিশ্বরূপ। এক সময়ের লড়াইয়ের সঙ্গীকে দেখেও সে দিকে এগিয়ে যাননি তাপস। এগিয়ে আসেননি বিশ্বরূপও। যদিও চোখাচোখি হয়েছে তাঁদের।
তাপস এবং বিশ্বরূপ— দু’জনেই বৌবাজারের ছেলে। রাজনৈতিক কর্মস্থল উত্তর কলকাতা। তাপস এক সময় বড়বাজারের বিধায়কও ছিলেন। পরে বরাহনগরের বিধায়ক হন তিনি। তবে সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তিনি। অন্য দিকে, বিশ্বরূপ ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর। যে ওয়ার্ডে ১০ বছর কাউন্সিলর ছিলেন তাপস নিজে। পোস্তা সেতু ভেঙে দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে বৌবাজারে মেট্রোর কাজের জেরে বার বার বিপর্যয়— যে কোনও পরিস্থিতিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন তাপস-বিশ্বরূপ। পরিস্থিতি সামলেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কিন্তু মঙ্গলবার সেই রকমের কোনও দৃশ্য চোখে পড়ল না। একে অপরকে এড়িয়েই গেলেন তাঁরা। তাপসের দাবি, বাড়ি বিপর্যয় নিয়ে বিশ্বরূপকে ‘অস্বস্তি’তে ফেলতে চাননি তিনি। আর সেই কারণেই তাঁর সঙ্গে কথাও বলেননি। অন্য দিকে, বিশ্বরূপ জানিয়েছেন, ‘গসিপ’ এড়াতেই তাপসের সঙ্গে কথা বলতে যাননি তিনি। তবে বিশ্বরূপ এ-ও জানিয়েছেন, তিনি এখনও চান ভোট মিটে গেলে তাপস যেন আবার তৃণমূলে যোগ দেন।
বৌবাজারের দুর্ঘটনাস্থল খতিয়ে দেখার পর তাপস বলেন, ‘‘আমি এখানেই বড় হয়েছি। এখানকারই ছেলে। যে বাড়ি ভেঙে পড়েছে সেটি পুরনো বাড়ি। মেট্রোর কাজের জন্য যে বাড়ি আমি ছেড়ে গিয়েছিলাম সেটা নতুন বাড়ি। সেটাও কাঁপে।’’ ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বাসিন্দাদের এর পর কী পদক্ষেপ করতে হবে, তা নিয়ে তাঁদের পরামর্শও দেন তাপস। কাউন্সিলরকে পুরো বিষয়টি জানিয়ে কলকাতা পুরসভার কমিশনার এবং পুলিশ কমিশনারকে চিঠিও দিতে বলেন। তবে বাড়ি বিপর্যয় নিয়ে তাঁর একদা আস্থাভাজন বিশ্বরূপের সঙ্গে কেন কথা বললেন না তিনি? প্রশ্নের জবাবে তাপস বলেন, ‘‘কাউন্সিলরকে কিছু বলে অস্বস্তিতে ফেলে লাভ নেই। আমি ওঁকে ছোট থেকে চিনি এবং জানি। ওঁর বাবা এখানে কাউন্সিলর ছিলেন। আমি নিজেও ১০ বছর কাউন্সিলর ছিলাম। আমি যা পরামর্শ দেওয়ার কথা ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বাসিন্দাদের বলেছি। কলকাতা পুরসভার কমিশনার এবং পুলিশ কমিশনারকেও চিঠি দিতে বলেছি।’’
অন্য দিকে, তাপসের সঙ্গে কথা না হওয়া নিয়ে বিশ্বরূপ বলেন, ‘‘মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত তাপসদার সঙ্গেও আমার সম্পর্ক তেমনই। আমি সব সময়ই সৌজন্যের রাজনীতি করে থাকি। আজকে তাপসদা আমাদের দল ছেড়ে অন্যত্র গিয়েছেন। আমাদের পথ আলাদা। আমি আমার দলের কথা বলব, তাপসদা ওঁর দলের কথা বলবে। সবাই সব কিছু সোজা ভাবে নিতে পারেন না। তাপসদার সঙ্গে কথা বললে অন্য রকম গসিপ হত। তাপসদা বড় নেতা। আমি চুনোপুঁটি। আমাকে নিয়ে গসিপ শুরু হয়ে যাবে। সেই কারণেই দূরে থাকা।’’
তাপসের প্রতি সম্মান থাকলেও লোকসভায় তাঁর ওয়ার্ড থেকে তৃণমূলই এগিয়ে থাকবে বলে জানিয়েছেন বিশ্বরূপ। পাশাপাশি এ-ও জানিয়েছেন, তিনি চান নির্বাচন শেষে আবার যেন তৃণমূলে ফিরে আসেন তাপস। তিনি বলেন, ‘‘মানুষকে আমি অনুরোধ করেছি। আমি সারা বাংলা বা সারা কলকাতার কথা বলতে পারব না। তবে এই ওয়ার্ড থেকে আমার দল এগিয়ে থাকবে। তাপসদাকে বলব, তুমি আবার ফিরে এসো। কারণ, তাপসদা আমাদের দলের অত্যন্ত উঁচু তলার মানুষ ছিলেন। আমি চাইব নির্বাচনের পর আবার দলে ফিরে আসুন তিনি।’’