(বাঁ দিকে) দিলীপ ঘোষ। সুকান্ত মজুমদার (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
বিজেপির ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতি বজায় রাখতে হলে বাংলায় রাজ্য সভাপতি বদল নিশ্চিত। কারণ, রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এখন কেন্দ্রে দু’টি দফতরের প্রতিমন্ত্রী। খাতায়কলমে রাজ্য সভাপতি বাছাইয়ের দায়িত্ব সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার হলেও কার্যত তা এখনও করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এ বার তিনি কাকে বাংলার সভাপতি বাছবেন, তা নিয়ে দলের মধ্যে বিভিন্ন জল্পনা শুরু হয়েছে। তবে ওই সিদ্ধান্ত নিতে খুব দেরি করা হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। সব ঠিকঠাক থাকলে চলতি মাসেই নামঘোষণা হয়ে যেতে পারে। কারণ, রাজ্যে দু’বছর পরেই বিধানসভা নির্বাচন। নতুন সভাপতিকে ‘ঘর’ গোছানোর সময় দিতে হবে।
তবে দিলীপ ঘোষ এবং সুকান্তের উত্তরসূরি বাছতে গিয়ে নাজেহাল পদ্মশিবির। বিজেপি সূত্রে একাধিক নাম নিয়ে আলোচনার কথা জানা গেলেও এখনও পর্যন্ত কারও নামেই সিলমোহর দেওয়া হয়নি। কারণ, এখনও কোনও নামকেই ‘সর্বগুণসম্পন্ন’ বলে মনে করছেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। সে ক্ষেত্রে সুকান্তের হাতেই আরও কিছু দিন দায়িত্ব রেখে দেওয়া হবে কি না, সে জল্পনাও রয়েছে।
শুধু বাংলা নয়, একই কারণে আরও দুই রাজ্যে সভাপতি বদল করতে হবে বিজেপিকে। শাহের নিজের রাজ্য গুজরাতও রয়েছে তার মধ্যে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে সে রাজ্যের সভাপতি করা হয় সিআর পাটিলকে। তাঁর নেতৃত্বেই ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সবচেয়ে ভাল ফল করেছিল। দ্বিতীয় দফায় তিনি সভাপতি হন ২০২৩ সালের জুলাইয়ে। এ বার পাটিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন। জলশক্তি মন্ত্রকের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পরে রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব ছাড়তে হতে পারে পাটিলকে।
একই ভাবে রাজ্য সভাপতি বদলের সম্ভাবনা তেলঙ্গানায়। ওই রাজ্যের সভাপতি জি কিষেণ রেড্ডি অবশ্য অনেক দিন থেকেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তেলঙ্গানার প্রথম রাজ্য সভাপতি ছিলেন তিনি। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তাঁকে আবার সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। অথচ ২০১৯ সাল থেকেই কেন্দ্রের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন রেড্ডি। ২০২১ সালে তিনি পূর্ণমন্ত্রী হন। বর্তমান মোদী মন্ত্রিসভাতেও তিনি কয়লা মন্ত্রকের পূর্ণমন্ত্রী।
এই নজির দেখিয়েই অনেকে মনে করছেন সুকান্তকে আরও কিছু দিন বাংলার দায়িত্ব রেখে দেওয়া হতে পারে। শুধু রেড্ডিই নন, বর্তমানে কেন্দ্রীয় জাহাজমন্ত্রী তথা অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী একই সঙ্গে দুই দায়িত্ব সামলেছেন। কেন্দ্রে পূর্ণমন্ত্রী থাকার পাশাপাশিই তিনি রাজ্য সভাপতিও ছিলেন। তবে সুকান্তের ক্ষেত্রে এই দুই নজির যে মানা হবেই, তার নিশ্চয়তা নেই। রাজ্য বিজেপির এক নেতার বক্তব্য, ‘‘তেলঙ্গানা ও অসমের সঙ্গে বাংলার তুলনা করা ঠিক নয়। ওই দুই রাজ্যের তুলনায় বাংলায় বিধানসভা ও লোকসভায় আসন সংখ্যা অনেক বেশি।’’ প্রসঙ্গত, বিজেপির সাংগঠনিক সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদের ‘এ’ ধারা অনুযায়ী, ২১টির বেশি লোকসভা বিশিষ্ট রাজ্যকে ‘বড় প্রদেশ’ হিসাবে ধরা হয়। যেটা তেলঙ্গানা বা অসম নয়। দু’টিই ‘মাঝারি প্রদেশ’। ফলে বাংলার জন্য ওই দুই রাজ্যের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম আলাদা। যদিও ২০১২ সালে সংশোধিত বিজেপির সংবিধানে সে ভাবে ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতির কথা বলা নেই। এটা দলের রীতি। আর বিজেপির সংবিধানে একটি ফাঁকও রাখা রয়েছে। দলের সর্বোচ্চ কমিটি ‘সংসদীয় বোর্ড’ (অনুচ্ছেদ ২৫) প্রয়োজনমতো যে কোনও রদবদল করা বা না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে ভাবেই নড্ডার পর পর দু’দফার মেয়াদ শেষের পরেও লোকসভা নির্বাচনের জন্য তাঁকে সর্বভারতীয় সভাপতি পদে রেখে দেওয়া হয়েছে। যা সাধারণ ভাবে ‘সংবিধান স্বীকৃত’ নয়।
তবে এ বার নড্ডার জায়গায় অন্য কোনও নেতাকে নিয়ে আসা হবে বলেই বিজেপি সূত্রের খবর। রাজ্যে রাজ্যে সভাপতি বদল অবশ্য তার আগে হয়ে যেতে পারে। মঙ্গলবারই হরিয়ানার সভাপতি বদল করা হয়েছে। ওই রাজ্যে টানা দু’দফার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মনোহরলাল খট্টর। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁকে সরিয়ে রাজ্যের ওবিসি মুখ নায়েব সিংহ সাইনিকে মুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপি। তিনি রাজ্যের সভাপতিও ছিলেন। খট্টর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সভাপতির দায়িত্বে মাস চারেক থাকার পরে তাঁকে বদল করল বিজেপি। সামনেই হরিয়ানা বিধানসভার নির্বাচন। দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে হরিয়ানায় বিজেপির সাংসদ সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাওয়ার পরে এ বার রাজ্য সভাপতি করা হল ব্রাহ্মণ মুখ মোহনলাল বডৌলীকে।
কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও ‘মুখ’ নিয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়নি বলেই জানা গিয়েছে। রাজ্য বিজেপির প্রথম সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক হরিপদ ভারতী। এর পরে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীকে। তিনিও ‘পণ্ডিত’ হিসাবে খ্যাত ছিলেন। পরেও তিনি রাজ্য সভাপতি হয়েছেন। মাঝে তপন শিকদার, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম ঘোষের মতো রাজনীতিকদের সেই দায়িত্ব দেওয়া হলেও মূলত অন্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিতদের বার বার বেছেছে বিজেপি। সেই পর্ব শেষ হয় আইনজীবী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে। ২০০৯ সালে আরএসএসের ‘ঘনিষ্ঠ’ রাহুল সিংহ এবং ২০১৫ সালে চমক দিয়ে নিয়ে আসা হয় সঙ্ঘের প্রচারক দিলীপকে। দিলীপের প্রায় দু’দফা সভাপতিত্বের সময়ে রাজ্যে বিজেপির অনেকটাই উত্থান হয়। কিন্তু একটা অভিযোগ ছিল যে, ‘মেঠো’ দিলীপের জন্য শহুরে, শিক্ষিত ভোটারের সমর্থন পাচ্ছে না বিজেপি। এর পরেই গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সুকান্তকে সভাপতি করা হয়। সুকান্তের সময়ে শহুরে ভোটারদের সমর্থন যে বেড়েছে, সেটা গত লোকসভা নির্বাচনে পুর এলাকাগুলিতে বিজেপির এগিয়ে থাকা থেকে প্রমাণিত। নবম ও দশমের দুই রকমের সাফল্য দেখার পরে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে একাদশ রাজ্য সভাপতি বাছাইয়ে তাই গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি।
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বড় রদবদল ঠিক হবে কি না, তা নিয়েও রাজ্য বিজেপিতে আলোচনা রয়েছে। সুকান্তের প্রথম দফা শেষ হতে এখনও কয়েক মাস বাকি। দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। তবে বিজেপির একটি মহল এটাও বলছে যে, রাজ্য সভাপতি বদল হবে ঠিক করার পরেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সুকান্তকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছেন। না হলে মন্ত্রী হওয়ার মতো অনেক সাংসদই ছিলেন বাংলায়। সভাপতি হওয়ার সম্ভাবনায় সবচেয়ে এগিয়ে রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকার। অতীতে জেলা সভাপতি জগন্নাথ শিক্ষকতা করতেন। সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। এ ছাড়াও নাম উঠছে সদ্য রাজ্যসভার সাংসদ হওয়া রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের। অতীতে বিজেপির একক শক্তিতে প্রথম বিধায়ক হওয়া শমীক রাজ্যে পরিচিত মুখ। বক্তা হিসাবে সুখ্যাতি রয়েছে। দলের আদি, নব্য দুই গোষ্ঠীর সঙ্গেই সম্পর্ক ভাল। আবার ‘মার্জিত’ ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সুনাম রয়েছে।
আলোচনায় থাকা তৃতীয় নাম জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো। পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় দিলীপ জমানা থেকেই রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন। সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তিনি দলের পরিচিত ‘আদিবাসী’ মুখ। কুর্মি সম্প্রদায়ের জ্যোতির্ময়ের বয়সও বাকিদের তুলনায় কম। জগন্নাথের মতো তিনিও পর পর দু’বার সাংসদ হয়েছেন। এ বার বিজেপি দু’টি মতুয়াপ্রধান আসনে জিতেছে। বনগাঁর সাংসদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন। তাই রানাঘাটের জগন্নাথকে রাজ্য সভাপতি করে ভোটের অঙ্কে নতুন কিছু সংযোজন হবে না। অন্য দিকে, বিজেপির নিম্নবর্গীয় ভোট বেশ কিছুটা কমেছে। আর কুর্মি সম্প্রদায়ের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের নজির সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে। ফলে কৃষক পরিবারের জ্যোতির্ময়কে বাছার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ কাউকে রাজ্য সভাপতি করার সম্ভাবনা বেশি। প্রসঙ্গত জগন্নাথ, শমীক, জ্যোতির্ময়— তিন জনেই আরএসএস থেকেই বিজেপিতে এসেছেন। নিজের নাম নিয়ে আলোচনার বিষয়ে কথা বলতে চান না শমীক। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়। কারণ, আমাদের দলের নিয়ম অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা দলের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক নেতৃত্বের।’’ শমীকের আরও দাবি, যে সব নাম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে হয়তো তাঁরা কেউই নন, একেবারে অন্য কোনও নামের কথা ভেবে রেখেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
বিজেপির কেউ কেউ মহিলা মুখের জল্পনা উস্কে দেবশ্রী চৌধুরী এবং লকেট চট্টোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে আলোচনা করছেন। তবে প্রাক্তন মন্ত্রী এবং প্রাক্তন সাংসদ দু’জনেই এ বার লোকসভা ভোটে পরাজিত। রাজ্য বিজেপির নেতাদের একাংশের বক্তব্য, কোনও পরাজিত মুখ বা মহিলা রাজ্য সভাপতি করার সম্ভাবনা কম।
বিজেপিতে সাধারণ ভাবে বিদায়ী রাজ্য সভাপতির কাছেও উত্তরসূরির নামের প্রস্তাব চাওয়া হয়। যে ভাবে সুকান্তের নাম প্রস্তাব করেছিলেন দিলীপ। এ বারেও সুকান্তের থেকে পছন্দের নাম জানতে চাওয়া হয়েছে বলেই বিজেপি সূত্রে খবর। একই ভাবে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর থেকেও জানতে চাওয়া হয়েছে নাম। সঙ্ঘের পছন্দ-অপছন্দও জানা হয়ে গিয়েছে। তবে কারও প্রস্তাব মানতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। রাজ্য সভাপতি বাছবেন মোদী ও শাহ। সিদ্ধান্তে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর দেবেন নড্ডা।