ভোটের ইস্তাহার প্রকাশের পরে কাদম্বিনীর নাম শোনা গিয়েছিল শাহর মুখেও। তারও আগে টিভি ধারাবাহিকে কাদম্বিনী রূপে জনপ্রিয় হয়েছিলেন শোলাঙ্কি।
ক্ষমতায় এলে ‘কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তহবিল’ গঠনের কথা বলেছিল। বিস্মৃত বাঙালি কন্যার নাম ইস্তাহারে দেখে অনেকেই চমকেছিলেন। অনেকে বলেছিলেন, এটা বাঙালি আবেগ ছোঁয়ার চেষ্টা। বিজেপি বলেছিল, মোটেও না। আমরা কৃতি মানুষদের স্মরণ করতে চাই। নতুন প্রজন্মকে চেনাতে চাই। কিন্তু হায়! ভোটে হেরে যাওয়া বিজেপি ভুলেই গেল যে, ১৮ জুলাই কাদম্বিনীর ১৬০তম জন্মদিন। রবিবার রাজ্যের কোথাও গেরুয়া শিবিরের তরফে কোনও অনুষ্ঠান নেই। তবে টুইট করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। আর যাঁরা ইস্তাহার বানিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ অনেক কষ্টে মনে করলেন। বললেন, ‘‘সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম।’’
গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিস্মৃত প্রায় বাঙালি কাদম্বিনীর নাম মনে করিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র পাশ করা প্রথম বাঙালি মেয়ে কাদম্বিনী, সারা জীবন সমাজজীবনে প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। কিন্তু নীলবাড়ির লড়াইয়ের আগে তিনি ভোট প্রতিশ্রুতির যুদ্ধে জায়গা পেয়ে যান। বাংলার নির্বচনী ইস্তাহারে ‘কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তহবিল’-এর কথা বলে বিজেপি। ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। জিতলে প্রতিটি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ ও জেলা হাসপাতাল তৈরির প্রতিশ্রুতি। প্রতিটি ব্লকে স্বাস্থ্য কেন্দ্র। প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। গোটা প্রকল্পের শিরোনামে থেকে যাবেন কাদম্বিনী। বিজেপি-র নীলবাড়ি দখলের স্বপ্ন অধরা থেকে গিয়েছে। সেই সঙ্গে কাদম্বিনীও যেন বিস্মৃতির অতলে।
কলকাতায় ঘটা করে ইস্তাহার প্রকাশ করেছিলেন অমিত শাহ। ফাইল চিত্র
বাঙালি নারীর অধিকারের লড়াইয়ে কাদম্বিনীর ভূমিকা নানা ভাবে আলোচিত। অনেক সামাজিক বাধা ডিঙিয়ে শুধু ডাক্তারি পাশ করেননি, ডাক্তারিও করেছেন। মহিলাদের উজ্জীবিত করেছেন স্বাবলম্বী জীবনের জন্য। পরিবারও সামলেছেন এর মধ্যে। ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তথাকথিত হিন্দু ধর্মের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বেধেছে। উগ্র হিন্দুরা তাঁকে ‘স্বৈরিণী’ বলে ব্যঙ্গচিত্র পর্যন্ত ছেপেছে। এমন এক মেয়ের নাম নীলবাড়ির লড়াই-এর নির্বাচনী ইস্তাহারে এসে যায়। ২১ মার্চ কলকাতায় সেই ইস্তাহার প্রকাশের পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আলাদা করে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের নামও উচ্চারণ করেছিলেন।
রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ভোটের আগে ভোটারদের মনে রাখা, আর ভোট মিটে গেলে ভুলে যাওয়ার অভিযোগ সনাতন। বাম থেকে বিজেপি— সব জমানাতেই হাটে-মাঠে-বাটে সাধারণের এই অভিযোগ শোনা যায়। তা বলে এত তাড়াতাড়ি! বিজেপি ইস্তাহার কমিটির অন্যতম সদস্য রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘মনে ছিল। কিন্তু সে ভাবে পালন করার কথা ভাবা হয়নি। আসলে চারদিকে এত গোলমাল, কর্মীরা ঘরছাড়া। তার মধ্যে আলাদা করে কোনও অনুষ্ঠান করার কথা ভাবা হয়নি।’’ ওই কমিটির আর এক সদস্য রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত যেন আনন্দবাজার অনলাইনের ফোন পেয়েই কাদম্বিনীর জন্মদিনের কথা জানলেন। বললেন, ‘‘আমি এখন কিছু মন্তব্য করব না।’’ আর এক সদস্য বিজেপি-র তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে পরিচিত অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জবাব, ‘‘রাজ্য দলের নেতাদের প্রশ্ন করুন। ওই কমিটির প্রধানের কাছে জানতে চান।’’ ওই কমিটির প্রধান চিকিৎসক সুভাষ সরকার এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। শোনা যায়, চিকিৎসক সাংসদের ইচ্ছাতেই কাদম্বিনী জায়গা পেয়েছিলেন ভোটের ইস্তাহারে। রবিবার বারংবার ফোন করা হলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে রাজ্য বিজেপি-র এক নেতা জানিয়েছেন, ‘‘করোনা পরিস্থিতর জন্য কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে না।’’
বিজেপি-র ইস্তাহারে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের উল্লেখ।
বিজেপি এমন গা বাঁচানো যুক্তি দিলেও রবিবারই ভার্চুয়াল মাধ্যমে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’। সেখানে অন্যতম বক্তা টিভিতে ‘প্রথমা কাদম্বিনী’ ধারাবাহিকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করা শোলাঙ্কি রায়। বাঙালি সমাজে কাদম্বিনীর গণপরিচয়টা শুরু হয় বছর খানেক আগে। দু’টি টিভি ধারাবাহিকের দৌলতে বাঙালির বৈঠকখানায় জায়গা পেয়েছিলেন দেশের প্রথম মহিলা লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসক। আম বাঙালিকে কাদম্বিনীর জীবনযুদ্ধ চেনায় দুই ধারাবাহিক ‘কাদম্বিনী’ ও ‘প্রথমা কাদম্বিনী’। রবিবার ছোট পর্দার কাদম্বিনী শোলাঙ্কি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘শুধু এক দিন নয়, প্রতি দিন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালির স্মরণে ও মননে থাকা উচিত। ছক ভাঙা জীবনের কাদম্বিনী তাঁর সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন।’’
ওই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে থাকছেন কাদম্বিনী গবেষক বরুণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনী ইস্তাহারে ১০ হাজার কোটি টাকার ‘কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তহবিল’- প্রকল্প প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছিল বিজেপি। প্রায় এক দশক ধরে এই মহিয়সীকে নিয়ে গবেষণা করছি, তাই ওই প্রতিশ্রুতি ভালই লেগেছিল। তবে ব্যাপারটা আন্তরিক কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল।’’
কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণে গুগলে রবিবারের ডুডল।
রবিবার গুগ্লের ডুডলেও রয়েছে কাদম্বিনী স্মরণ। সেই কথা উল্লেখ করে বরুণের আরও বক্তব্য, ‘‘কাদম্বিনী বিষয়ে সামান্য চর্চা করলেই স্পষ্ট হবে যে, বিজেপি-র আদর্শের সঙ্গে তাঁকে আঁটানো মুশকিল। আজ বোঝা গেল সংশয়টাই ঠিক ছিল। আমার তৃপ্তিটাই ছিল অলীক। গুগ্ল ডুডল-সহ বহু পরিসরে রবিবার কাদম্বিনীর ১৬০তম জন্মদিন স্মরণ করা হচ্ছে, বিজেপি কিন্তু নির্বাক, বিস্মৃত। চমকের জাদু আর ক’দিন থাকে!’’