Suvendu Adhikari

দিলীপ না শুভেন্দু? সংগঠনে কার জোর কতটা, স্পষ্ট বলা আছে বিজেপি-র সংবিধানে

নবাগত শুভেন্দু দলের রীতি-রেওয়াজ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন বলেই অনেক বিজেপি নেতা মনে করেন। কিন্তু দলীয় সংবিধান অন্য কথা বলছে।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২১ ১৫:৫২
Share:

বিজেপি-র সংবিধানে যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ পদ বিরোধী দলনেতা। ফাইল চিত্র

পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-তে বরাবরই সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে এসেছেন রাজ্য সভাপতি। কারণএর আগে বাংলায় বিরোধী দলনেতা পদে কোনও দিন বিজেপি-র কেউ থাকেননি। নীলবাড়ি দখলের স্বপ্ন পূরণ না হলেও এই প্রথম বড় সংখ্যায় বিধায়ক নিয়ে প্রধান ও একমাত্র বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা হয়েছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। আর তার পর থেকেই একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে— রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ নাকি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু?সংগঠনে কার গুরুত্ব বেশি?অধিকারের প্রশ্নটিও সামনে এসে গিয়েছে। দিলীপ-শুভেন্দু প্রকাশ্য বিবাদ না থাকলেও রাজনৈতিক মহলে দুই শিবিরের মধ্যে দূরত্বের কথা এখন সর্বজন বিদিত।

Advertisement

অতীতে রাজ্য বিজেপি সভাপতির দায়িত্ব অনেকেই পালন করেছেন। তপন সিকদার থেকে রাহুল সিংহরা সভাপতি থাকার সময় টুকটাক রাজনৈতিক সাফল্য মিললেও দিলীপের আমলেই বিজেপি লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। সে দিক থেকে বিচার করলে দিলীপই রাজ্য বিজেপি-র সবচেয়ে ‘সফল’ সভাপতি। যিনি নিজেও একাধিকবার নির্বাচনে জিতেছেন এবং দলকে জিতিয়েছেন। এর আগে এমন সাফল্য শুধু দেখিয়েছেন অধুনাপ্রয়াত তপন। কিন্তু তখনকার বিজেপি আর এখনকার বিজেপি-র মধ্যে অনেক ফারাক। অন্য রাজনৈতিক দল থেকে মুকুল রায় বা শুভেন্দুর মতো নামজাদা নেতারা তখন বিজেপি-তে আসেননি। রাজ্য বিজেপি-র দিলীপ শিবিরের নেতাদের বক্তব্য, দলের ভিতরেও অনেক প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে‘দিলীপদা’ নিজের জায়গা ধরে রেখেছেন। মুকুল ফিরে গিয়েছেন তৃণমূলে। রয়েছেন শুভেন্দু। এবং বিরোধী দলনেতা হিসেবে।

এই জায়গা থেকেই তুল্যমূল্য বিচার শুরু হয়েছে বিজেপি-তে। সম্প্রতি শুভেন্দুর দিল্লি সফর নিয়ে দিলীপের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সমীকরণ প্রকাশ্যে চলে আসে। দিলীপকে যে না জানিয়েই শুভেন্দু যে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জেপি নড্ডাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন, তা প্রকাশ্যে এসে যায়। দিলীপ নিজেই সাংবাদিক বৈঠকে তা খোলসা করে দেন। তার পর দলের বিধায়কদের নিয়ে শুভেন্দু রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের কাছে যাওয়ার পরেও দিলীপ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তাঁকে অন্ধকারে রেখেই ছিল ওই রাজভবন সফর।

Advertisement

রাজভবনে শুভেন্দু-ধনখড় বৈঠক। ফাইল চিত্র

দু’টি ক্ষেত্রেই শুভেন্দু জানিয়েছিলেন, তিনি সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তীকে জানিয়েই সফরের পরিকল্পনা করেছিলেন। এ নিয়ে দিলীপ অনুগামীদের বক্তব্য ছিল, অমিতাভকে জানালেও দলের বিধায়কদের নিয়ে রাজভবনে যাওয়া বা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে সৌজন্যের খাতিরেই রাজ্য সভাপতিকে বলা উচিত ছিল শুভেন্দুর। এটাই বিজেপি-র রীতি। দলে নবাগত শুভেন্দু দলের রীতি-রেওয়াজ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন বলেই এমনটা করেছেন বলেও অনেকে মন্তব্য করেছিলেন।

বিজেপি-র ‘রীতি’, ‘রেওয়াজ’, ‘সৌজন্য’ ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। তবে বিজেপি-র দলীয় সংবিধানে কিন্তু এমন কোনও বাধ্যবাধকতার কথা বলা নেই। কোনও রাজ্যে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ও রাজ্য সভাপতি সংগঠনের কোন ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্ব পাবেন, তা স্পষ্ট করে বলা রয়েছে ৪৪ পাতার দলীয় সংবিধানে। তা দেখলে এটা স্পষ্ট যে, সাংগঠনিক ভাবে অনেক ক্ষেত্রেই দু’জনেই সমান গুরুত্বের অধিকারী।

বিজেপি-র সংবিধানে ভারতের সব রাজ্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা রয়েছে। তাতে ২১টির বেশি লোকসভা আসন থাকায় পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় শ্রেণিতে। এই শ্রেণিভাগ অনুসারে রাজ্য স্তরে কোন পদে কতজন থাকতে পারেন, তা ঠিক করা রয়েছে। কিন্তু সব রাজ্যের ক্ষেত্রে এটা কোথাও বলা নেই যে, পরিষদীয় নেতাকে সব বিষয়ে রাজ্য সভাপতির পরামর্শ নিতেই হবে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের যে কোনও বৈঠকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সভাপতি ও বিরোধী দলনেতা সমান মর্যাদা পাবেন। সংবিধানের ৯ এবং ১০ পৃষ্ঠায় ১৬ এবং ১৭ ধারায় উল্লেখ করা রয়েছে প্রদেশ পরিষদ (স্টেট কাউন্সিল) এবং প্রদেশ কার্যাকারিণী (স্টেট এগ্‌জিকিউটিভ)-এর বৈঠকে রাজ্য সভাপতির সমান গুরুত্ব দিতে হবে বিধানসভা কিংবা বিধান পরিষদের নেতাকে। প্রসঙ্গত আগামী মঙ্গলবার হতে চলেছে রাজ্য বিজেপির কার্যকারিণী বৈঠক। তাতে দিলীপের পাশাপাশি শুভেন্দুও রয়েছেন বক্তার তালিকায়।

আবার ১৮ ধারায় রাষ্ট্রীয় পরিষদ (ন্যাশনাল কাউন্সিল) এবং ১৯ ধারায় রাষ্ট্রীয় কার্যকারিণী (ন্যাশনাল এগ্‌জিকিউটিভ)-এর বৈঠকেও আমন্ত্রিত হবেন রাজ্য সভাপতি ও বিরোধী দলনেতা। একই ভাবে দলের প্লেনারি অধিবেশন (ধারা ২২) ও বিশেষ অধিবেশনেও (ধারা ২৩) আমন্ত্রিত হবেন তিনি।সংগঠন ও পরিষদীয় দল কী ভাবে সমন্বয় রেখে চলবে, তা-ও দলীয় সংবিধানের ২৮ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে দেওয়া রয়েছে। এর জন্য রাজ্য সভাপতি একটি সাত সদস্যের কো-অর্ডিনেশন কমিটি তৈরি করতে পারেন। সেই কমিটিতে চেয়ারম্যান হবেন রাজ্য সভাপতি। বাকি সদস্যদের মধ্যে তিনজন হবেন রাজ্য কার্যকারিণীর সদস্য এবং বাকি তিনজন হবেন বিরোধী দলনেতা-সহ তিন বিধায়ক। এই কমিটি চলবে কেন্দ্রীয় সংসদীয় বোর্ডের পরামর্শমতো। তবে রাজ্যে কোনও সাংগঠনিক রদবদল করতে হলে তার সম্পূর্ণ অধিকার সভাপতির হাতে। সেটা বিভিন্ন শাখা সংগঠনের ক্ষেত্রেও।

দলীয় সংবিধানে রাজ্য সভাপতি ও বিরোধী দলনেতার মধ্যে সমন্বয়ের লক্ষ্য কমিটি গড়ার সুযোগ রাখা রয়েছে।

শুধু রাজ্য নয়, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও বিজেপি-তে সভাপতির সঙ্গে বিরোধী দলনেতার সমান গুরুত্বের কথা বলা রয়েছে। তার সবচেয়ে বড় উদাহণ লালকৃষ্ণ আডবাণী বিজেপি সভাপতি থাকার সময় সংগঠনে সমান গুরুত্ব পেতেন লোকসভায় বিরোধী দলনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী। আবার বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন তাঁর থেকে রাজনৈতিক ভাবে ধারেভারে পিছিয়ে থাকলেও সংগঠনে সমান গুরুত্ব পেতেন তৎকালীন সভাপতি জনা কৃষ্ণমূর্তি। এমন উদাহরণ অনেক আছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীর নাম প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার পরেও গোয়ায় রাষ্ট্রীয় কার্যকারিণীর বৈঠকে মঞ্চে জায়গা পাননি তিনি। কারণ, মোদী একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন। তবে পরে তাঁকে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান ঘোষণা তাঁকে মঞ্চেতোলা হয়। সেই মঞ্চে ছিলেনবর্তমানে মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য রাজনাথ সিংহ। আর বিরোধী দলনেত্রী হিসেবে ছিলেন প্রথম মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য প্রয়াত সুষম স্বরাজ।

২০১৪ সালে গোয়ায় বিজেপি-র রাষ্ট্রীয় কার্যকারিণী বৈঠক। ফাইল চিত্র

শুভেন্দু দলের সাংবিধানিক অধিকার বলে বহু ক্ষেত্রেই দিলীপের সমান সুযোগ পেলেও কোনও সাংগঠনিক নির্বাচনে লড়াই করতে পারবেন না। কারণ, সংবিধানের১২ ধারায় বলা রয়েছে,সক্রিয় সদস্যরাই (অ্যাক্টিভ মেম্বার) সেই অধিকার পান। আর তা হতে গেলে কমপক্ষে তিন বছর দলের সাধারণ সদস্য থাকতে হয়। তবে নেতৃত্ব চাইলে প্রয়োজন মতো ওই নিয়মে বদল আনা যায়। সভাপতি বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সব সময়ই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সেটা যে সম্ভব তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ দিলীপ। রাহুলের পর প্রচারক দিলীপকে রাজ্য সভাপতি করার পরিকল্পনা ছিল সঙ্ঘ পরিবারের। তাই ২০১৫ সালে সরাসরি রাজ্য সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিজেপি-তে যোগ দেন দিলীপ। কয়েক মাসের মধ্যেই সভাপতি নির্বাচিত হন। তাই অতীতের নজির দেখিয়ে দলের একাংশেরঅভিমত, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘পছন্দের পাত্র’ শুভেন্দুকে সাংগঠনিক পদে নিয়ে এলে বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকবে না। তবে পাশাপাশিই দলের ওই অংশের বক্তব্য, শুভেন্দুকে পরিষদীয় রাজনীতির বৃত্তেই রাখা হবে। সংগঠনে তাঁর কোনও ভূমিকা সে ভাবে থাকবে না। সংগঠন থাকবে দিলীপের হাতেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement