মুকুল কি দু’কূল হারা? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
২০১৭ সালে যে প্রশ্ন উঠেছিল রাজ্য রাজনীতিতে সেই প্রশ্নই আবার উঠল ২০২৩ সালে। মুকুল রায় কোন দলে? এই ছ’বছরে অবশ্য অনেক বদলে গিয়েছেন মুকুল। সেই মুকুল আর এই মুকুলে অনেক ফারাক। তখন তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজনীতিক। আর এখন কথার খেই হারিয়ে ফেলা অসুস্থ মানুষ।
২০১৬ সালে তৃণমূল দ্বিতীয় বার রাজ্যের ক্ষমতায় আসার বছর খানেক পর থেকেই দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে মুকুলের। সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করেন, তিনি তৃণমূল ছাড়ছেন। সেই দিনই সকালে রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু এর পরেও বিজেপিতে যোগদানের মুহূর্ত সহজে আসেনি। দীর্ঘ দিন দিল্লিতে বসে থাকতে হয়েছিল তখন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের ডাক পাওয়ার অপেক্ষায়। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যোগদান পর্ব মেটে ৩ নভেম্বরে। এর পরে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে কলকাতায় ফেরেন মুকুল।
এ বার নিরাপত্তারক্ষীদের কলকাতা বিমানবন্দরের বাইরে রেখে দিল্লি গিয়েছেন মুকুল। তার পরেই তাঁর পুত্র তথা প্রাক্তন বিধায়ক শুভ্রাংশু রায় জানিয়েছেন, বাবার মাথার ঠিক নেই। সোমবার সন্ধ্যায় কলকাতা ছেড়ে ‘চুপি চুপি’ দিল্লি চলে যাওয়ার পর থেকে রাজ্য রাজনীতির কোনও মুখ্য চরিত্রই মুকুল সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনও কথা বলেননি। যেটুকু যা বলছেন শুভ্রাংশু। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বদনাম করতে বাবাকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, ‘‘আমার ব্যক্তিগত মত, অভিষেককে কালিমালিপ্ত করতে কোনও একটি রাজনৈতিক দল খেলায় নেমেছে। কারণ, এখন নিশানা অভিষেক। তিনিই দলটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।’’ শুভ্রাংশুর এই দাবি সমর্থন করতে তৃণমূলের কেউই এগিয়ে আসেননি। উল্টে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘অভিষেককে জড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়। অভিষেককে নিয়ে অনেক দিন ধরেই অনেক কিছু চলছে। মুকুলবাবু তো কিছু বলেননি। এখন তাঁর ছেলে অভিষেকের নাম করছেন। এ সব বড় বড় ব্যাপার। মুকুলবাবু তিন দিন বিজেপিতে থাকেন। তিন দিন তৃণমূলে। রবিবার বাড়িতে বসে চা খান।’’ তবে কি মুকুল তৃণমূলের নয়? কুণাল বলেন, ‘‘বিজেপিতে আছেন কি নেই, সেটা নিয়ে (বিধানসভা) স্পিকারের একটা পর্যবেক্ষণ আছে। এর উপর নতুন করে দলের মুখপাত্র হিসাবে আমার বলার কিছু নেই। একটা জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাতে অভিষেকের নাম টেনে আনার কোনও যুক্তি নেই।’’
খাতায়কলমে বিজেপি বিধায়ক হলেও মুকুলের সঙ্গে বিজেপির এখন দূরত্ব অনেক। তাঁর বিধায়কপদ খারিজের দাবিতে সরব গেরুয়া শিবির। যদিও বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, মুকুল এখনও বিজেপিতেই রয়েছেন। তাই তিনি বিজেপির বিধায়ক। তৃণমূলে যোগ দেওয়ার কোনও প্রমাণ নেই। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে ভাবে কেউই গেরুয়া শিবিরের অবস্থান স্পষ্ট করেননি। বরং ধোঁয়াশা তৈরি করে দিয়েছেন বিজেপি নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ অনুপম হাজরা। মুকুলের দিল্লিযাত্রার পর অনুপমের ফেসবুক পোস্ট মুকুলকে নিয়ে জল্পনা আরও বাড়িয়ে দেয়। অনুপম লেখেন একটিই শব্দ— প্রত্যাবর্তন।
এর অর্থ কি মুকুলের বিজেপিতে ফিরে যাওয়া? অনুপমকে প্রশ্ন করায় তিনি শুধু বলেছেন, ‘‘একটা দিন অপেক্ষা করুন। সবই স্পষ্ট হয়ে যাবে।’’ অনুপমের এই বক্তব্যের সমর্থনেও রাজ্য বা কেন্দ্রীয় বিজেপির কেউ এগিয়ে আসেননি। রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্ব কমাতেই অনুপমকে বিজেপি সর্বভারতীয় সম্পাদক করেছিল। আবার জাতীয় রাজনীতিতেও তাঁর তেমন কোনও ভূমিকা নেই। ফলে গেরুয়া শিবিরও অনুপম কী লিখেছেন তা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। ফলে মুকুল আপাতত ত্রিশঙ্কু। এক কূলে তৃণমূল। অন্য কূলে বিজেপি। তবে রাজ্য রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, এ কূল ও কূল দু’কূলই হারিয়েছেন মুকুল।