জল্পনা বাড়ল মুকুলকে নিয়ে। — ফাইল চিত্র।
কী করছেন মুকুল রায়? কী করবেন মুকুল রায়? সোম সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার দিন গড়িয়ে রাত— কৃষ্ণনগর উত্তরের বিজেপি বিধায়ক মুকুলকে নিয়ে জল্পনা চলছে। তবে তিনি যে ‘নিখোঁজ’ নন, সেটা জানিয়ে দিয়েছেন মুকুল স্বয়ং। এ-ও জানিয়েছেন যে, তিনি দিল্লিতে রয়েছেন। ফলে মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায় ‘নিখোঁজ’ ডায়েরি করলেও তার আইনি যৌক্তিকতা থাকছে না। কিন্তু এখন প্রশ্ন, মুকুলকে নিয়ে পুলিশি তদন্ত কি ‘অপহরণ’-এর পথে এগোতে পারে? এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না আইনজীবীরা। মুকুলের সঙ্গে যে দু’জন দিল্লি গিয়েছেন বলে বিমানের যাত্রিতালিকা থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কি অপহরণের অভিযোগ তোলা যেতে পারে? আইনজ্ঞরা মনে করছেন, পারে। কিন্তু তা ‘প্রমাণসাপেক্ষ’।
শুভ্রাংশুর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে মঙ্গলবার বিজেপির দক্ষিণ দমদম মণ্ডলের নেতা পীযূষ কানোরিয়াকে তলব করেছে বিধাননগর থানার পুলিশ। তাঁকে জেরা করা হচ্ছে। তদন্তকারীরা মনে করছেন, মুকুলের দিল্লিযাত্রার পিছনে পীযূষের ‘ভূমিকা’ থাকতে পারে। মুকুল দিল্লিতে কোথায় রয়েছেন, তার খোঁজ নিতে ইতিমধ্যেই দিল্লি গিয়েছে বিধাননগর থানার একটি দল।
সোমবার সন্ধ্যার উড়ানে কলকাতা থেকে দিল্লি গিয়েছেন মুকুল। তাঁর সঙ্গে ওই উড়ানে দু’জন ছিলেন। তাঁদের নাম ভগীরথ মাহাত এবং রাজু মণ্ডল। মুকুলের পুত্র শুভ্রাংশুর দাবি, মুকুল যে সল্টলেকের বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাচ্ছেন, তা তাঁর জানা ছিল না। সেই কারণেই তিনি সোমবার সন্ধ্যায় দু’টি থানায় তাঁর বাবা ‘নিখোঁজ’ বলে অভিযোগ দায়ের করেন। প্রথমে বিমানবন্দর থানা এবং পরে বীজপুর থানায়। তার পরেই জানা যায়, মুকুল গিয়েছেন দিল্লি। সেকথা মুকুল নিজেই জানান দিল্লি বিমানবন্দরের বাইরে। কিন্তু কথা বলার সময় দৃশ্যতই তাঁকে খানিকটা অশক্ত এবং দুর্বল দেখিয়েছে। কথাবার্তাও খানিক অসংলগ্ন শুনিয়েছে।
আপাতত পুলিশের হাতে যা যা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম শুভ্রাংশুর বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘‘বাবার পারকিনসন্স রয়েছে, ডিমেনশিয়া রয়েছে। এমনকি, লিভার সিরোসিসও রয়েছে। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে কী হচ্ছে জানতে চাওয়া হলে উনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সমস্যা চলছে। উনি অসুস্থ। এমতাবস্থায় ওঁকে নিয়ে এই জল্পনার নীচু মানের রাজনীতি না করাই কাম্য।’’ নাম না করলেও মুকুলপুত্রের ইঙ্গিত বিজেপির দিকেই। তবে তৃণমূল এখনই এ নিয়ে কিছু বলবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন শাসকদলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ।
তাঁর বাবার যে মস্তিষ্কের সমস্যা রয়েছে, তা জানিয়ে শুভ্রাংশু বলেছেন, ‘‘মুকুল রায় মানসিক ভাবে সুস্থ নন। এখানে টাকার খেলা হয়েছে।’’ বিমানে চড়ে দিল্লি যাওয়ার অর্থ মুকুল কোথা থেকে পেলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শুভ্রাংশু। সেই সূত্রেই তাঁর সংযোজন, ‘‘গতকাল (সোমবার) একটি এজেন্সির তরফে এক অবাঙালি ব্যক্তিকে বলা হয়, মুকুল রায়ের হাতে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আসার জন্য।’’ কেন, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন শুভ্রাংশু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বাবার হাতে টাকা নেই। এখন বাবার মাসিক আয় পেনশন থেকে ২১ হাজার টাকার মতো।’’ একই সঙ্গে শুভ্রাংশু বলেন, ‘‘তিনি হাঁটতে পারছেন না ভাল করে। অস্ত্রোপচারের আগে পর্যন্ত বাবাকে ডায়াপার পরিয়ে রাখতে হত।’’ বাবার অসুস্থতা সম্পর্কিত মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখিয়ে শুভ্রাংশু মঙ্গলবার সকালে বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত বাবার সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ হয়নি। উনি ইনসুলিন নিচ্ছেন কি না জানি না। বাবা দিনে ১৮টি ওষুধ খান। আমার বাবার কিছু হলে তার দায়ভার কে নেবে?’’ বিকেলের দিকে শুভ্রাংশু এমনটাও বলেন যে, মুকুলের দিল্লিযাত্রার পিছনে কোনও ‘চক্রান্ত’ থাকতে পারে। মুকুল এখনও ২০১১-’১২ সালে বাস করেন বলেও দাবি করেছেন তিনি।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কি মুকুলকে ‘অপহরণ’ করা হয়েছে বলে তদন্ত শুরু করা যেতে পারে? আইনজীবী তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘কোনও একটা উদ্দেশ্যে নিয়ে গেলে অপহরণের মামলা হয়। আটকে রাখা হয়েছে বলা হলেও সেটা ‘অপহরণ’ বলা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষে এমন অভিযোগ তুলতে হবে যে, কারও কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে। শেষ বার কখন, কোথায় দেখা হয়েছে। কোনও পরিচিত না কি অপরিচিত লোক নিয়ে গিয়েছে। এর ভিত্তিতে পুলিশ ৩৬২ ধারায় অপরহণের মামলা রুজু করতে পারে। আবার গোপনে এবং অন্যায় ভাবে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখার অভিযোগ আনা যেতে পারে ৩৬৫ ধারায়।’’
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘কোনও ব্যক্তিকে ভুল বুঝিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলে সেটা অপহরণ।’’ শুভ্রাংশু যে সব অভিযোগ তুলেছেন, তাতে অপহরণের মামলা করা যায় জানিয়েও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন জয়ন্তনারায়ণ। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ মুকুল রায়কে অপহরণ করবে কেন? শুভ্রাংশু রায় যেমনটা বলেছেন, সেটা ঠিক হলে ওঁকে নিয়ে তো কারও কোনও রাজনৈতিক সুবিধা হতে পারে না! একটা বিষয়ই শুধু হতে পারে যে, ওঁর কাছে এমন কিছু তথ্য রয়েছে, যা বার করা নেওয়া উদ্দেশ্য। কিন্তু তার জন্য এমন অসুস্থ মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে কার কী লাভ হবে? রাজনীতিকদের বদনামের ভয় তো রয়েছে। তাঁরা এই ধরনের ঝুঁকি নেবেনই বা কেন?’’
মুকুলকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পিছনে ‘বিজেপির চক্রান্তের’ যে অভিযোগ উঠেছে, সেই প্রসঙ্গে জয়ন্তনারায়ণ বলেন, ‘‘ধরা যাক ওঁর কাছে এমন কোনও গোপন তথ্য রয়েছে, যা অন্য একটি রাজনৈতিক দলের বিপদ বাড়াতে পারে। সেটা বার করার জন্য কেউ নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য কোনও তদন্তকারী সংস্থা লাগিয়ে গ্রেফতার করে নিলেই হত। অসুস্থ মানুষকে দিল্লি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কেউ নিতে যাবে কেন?’’
মুকুলের সঙ্গী হিসাবে যাঁদের নাম পাওয়া যাচ্ছে, সেই ভগীরথ এবং রাজুর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা কি নিতে পারে পুলিশ? জয়ন্তনারায়ণ বলেন, ‘‘তাঁর সঙ্গে কেউ ছিল এমনটা বলা যাবে কী করে? হয়তো তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, এমন কারও ছবি দেখা গিয়েছে। তার মানে তো এটা নয়, যে ওই লোকটা অপহরণ করেছে!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘কোনও মস্তিস্কবিকৃত মানুষকে দেখে কেউ যদি কথাও বলে আর সেটা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তাতেও অপহরণ বোঝায় না। কোনও অসৎ উদ্দেশ্যে তুলে নিয়ে যাওয়া হলে তখন অপহরণ বলা যায়। যাঁদের ছবি দেখা যাচ্ছে, তাঁদের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে কি না, সেটাও তো আগে দেখতে হবে! পাশে পাশে হাঁটা মানেই অপহরণ নয়। তাঁর কোনও লাভ রয়েছে কি না সেটাও মাথায় রাখতে হবে।’’