তখনও পাশাপাশি: ২০১৭ সালে আন্দোলনের সময়। ফাইল চিত্র
বাড়ির এই অংশটা তৈরি হয়নি তখনও। তবে মাথার উপরে ছাদ আছে। তখনও প্লাস্টার পড়েনি দেওয়ালে। সেখানে রাজকীয় একটি চেয়ার। তাতেই এসে নিয়মিত বসতেন তিনি। পিছনের দরজার উপরে লেখা আছে ‘পাহাড় কি রানি’। তাঁর সামনে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে নিজেদের কথা জানাতেন পাহাড়ের লোকজন, ঠিক যেন দরবার চলছে।
তখন বিমল গুরুংয়ের অন্য চাকচিক্য। নিজে মোবাইল ফোন রাখেন না। সেটা থাকত তাঁর অন্যতম সহচর দীপেন গুরুংয়ের কাছে। পাতলেবাসের এই বাড়িটিতেই তাঁকে শেষ বারের মতো দেখা গিয়েছিল ২০১৭ সালের আন্দোলনের প্রথম পর্বে। রাজ্য গোয়েন্দা সূত্রে বলা হয়, তার পরে তিনি পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে চলে গিয়েছিলেন পড়শি রাজ্যে।
যদিও এই নিয়ে কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। তবে তাঁর দীর্ঘ অজ্ঞাতবাস, তাঁকে ধরতে গিয়ে নামচিতে গুলির লড়াই বা সিকিম-পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় গুলিযুদ্ধে অমিতাভ মালিকের মৃত্যু বিমলকে আরও অনেক রহস্যময় করে তুলেছে। তিনি নেই পাহাড়ে। কিন্তু তাঁর ছায়া রয়ে গিয়েছে এলাকার সর্বত্র।
২০০৮ সালের আন্দোলন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত, সব সময়ই বিমল এক জন জননেতা। তাঁর ডাকে হাজার হাজার মানুষ এগিয়ে আসেন। তিনি হাঁক দিলে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায় সর্বত্র। এ বারে লোকসভা ভোটে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভও মানুষ উজাড় করে দিয়েছে বিমলের প্রার্থীর পাশে দাঁড়িয়ে। ‘‘পাহাড়ের মানুষ রক্তপাত চায় না। তবে নিজের হকের জন্য লড়াই করতেও জানে তারা,’’ বলছিলেন লামাহাটার এক সিভিক পুলিশ।
‘জননেতা’ বিমল তোয়াক্কা করতেন না কিছুই। ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে প্রথম বার নিজের পছন্দমতো প্রার্থী, বিজেপির যশোবন্ত সিংহকে জিতিয়ে আনেন বিমল। যশোবন্তের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ছিল ম্যাল চৌরাস্তায়, ভরা পর্যটন মরসুমে পর্যটকদের সুবিধা-অসুবিধার তোয়াক্কা না করেই। ২০১৭ সালেও যখন হঠাৎ অনির্দিষ্টকালের বন্ধ ডাকেন বিমল, তখনও পাহাড়ে পর্যটন মরসুম। তখনও তিনি দার্জিলিঙের অবিসংবাদী নেতা। তাই, কী ভাবে তিনি এক ঘোষণায় এত পর্যটককে বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন, সেই প্রশ্ন কেউ করেনি।
এর ঠিক তিন মাস পরে নতুন আর এক নেতার জন্ম হয়। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা সর্বদল বৈঠকে যোগ দিতে আসেন বিনয় তামাং। সাংবাদিক বৈঠকে তাঁকে একটু নার্ভাস লাগছিল। পাহাড়ে ফিরতে পারবেন না, এমন ভয় পাচ্ছেন কি? হেসেছিলেন বিনয়। সত্যিই তো, বিমল চাননি বলে একসময় দিল্লি থেকে ফিরে পাহাড়ে ঢুকতে পারেননি সুবাস ঘিসিং। কিন্তু বিনয়ের ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটল না। তিনি ফিরলেন। কারণ, প্রথমত, তাঁর পিছনে রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। দ্বিতীয়ত, বিমলও তখন আর পাহাড়ে ছিলেন না।
তবে বিরোধিতা ছিল। সেই বিরোধী স্রোত সামলে এগিয়েছিলেন বিনয়। প্রথমে কার্শিয়াং, তার পরে নিজের শহর দার্জিলিঙে পৌঁছন তিনি।
সত্যিই কি বিনয়কে সর্বদল বৈঠকে যোগ দিতে পাঠিয়েছিলেন বিমল? নাকি প্রথমে সম্মতি দেওয়ার পরে রাজ্যের সঙ্গে বিনয়ের শান্তি খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলেন তিনি? তাই কি বিনয়কে বিশ্বাসঘাতক বলেও দেগে দিতে চেয়েছিলেন?
দীর্ঘদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের সঙ্গী। তবু বিমল বরাবরই মূলত জনপ্রিয় নেতা, বিনয় সংগঠক। পিছনে থেকে সংগঠনকে মজবুত করার, তাকে ধরে রাখার কাজ করতেন। লোকসভা ভোটের আগে রাজভবনের কাছে একটি হোটেলের ঘরে নিজের ওয়ার রুম করে নিয়েছিলেন। সেখানে দিস্তা দিস্তা কাগজে ছোট ছোট এলাকা ধরে পাহাড়ের যাবতীয় রিপোর্ট থাকত তাঁর হাতের মধ্যে। সে সব সামনে রেখে সঙ্গীদের নিয়ে কৌশল ঠিক করতেন। জানিয়েছিলেন, কী ভাবে বারবার ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার করছেন তাঁরা। প্রতি জনের কাছে একাধিকবার পৌঁছে তাঁকে বোঝাচ্ছেন, কেন ভোটটা তৃণমূল প্রার্থী অমর সিংহ রাইকে দিতে হবে। কিন্তু দিনের শেষে দেখা যায়, ‘সংগঠক’ বিনয় তামাং হেরে গেলেন ‘জননেতা’ বিমল গুরুংয়ের কাছে।