পারিবারিক সূত্রে ছাত্রাবস্থাতেই বামপন্থী রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল। আমাদের পরিবার থেকেই মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রথম লালঝান্ডা তোলা হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী জেঠামশাই তারাপদ গুপ্ত ছিলেন অনুশীলন দলের কর্মী। তিনি ১৯৩৬ সালে এ জেলায় কমিউনিস্ট লিগ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতরক্ষা আইনে ধৃতদের আইনজীবী হিসাবে বাবা বিজয় গুপ্ত বিনা পারিশ্রমিকে বহু মামলা লড়েছেন। বাবা ছিলেন এ জেলার ব্যক্তি স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। সেই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার আমাকে গত শতাব্দীর আশির দশকে ভারতের কমিউনিস্ট পাটি (সিপিআই)-র মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য করেছিল।
আমি নিজেই এক সময় বন্ধ, ঘেরাও ও পথ অবরোধের মতো আন্দোলনে বহুবার শামিল হয়েছি। আজ বুঝি ভুল করেছি। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, বন্ধ আজ বন্ধ্যা রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বন্ধ আজ নিরীহ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাত শক্ত করে।
একটা সময় বন্ধ ছিল শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার। ছিল মেহনতি মানুষের শেষ অস্ত্র। কিন্তু দিগভ্রান্ত বামপন্থার হাতে পড়ে বন্ধ আজ অন্তঃসারশূন্য রাজনীতির জন্ম দিচ্ছে। দিনআনি দিনখাই মানুষের জীবনে সর্বনাশা বন্ধ অভিশাপের মতো। বন্ধের ফলে পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে যেতে পারে না, রোগীকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া যায় না, বিবাহ অনুষ্ঠান পণ্ড হয়। বলা নেই, কওয়া নেই দুম করে রাস্তা আটকে নিরীহ পথচারীকে পীড়ন করা হয়। দাবি পূরণের জন্য বন্ধ ও পথ অবরোধ করা হয়, সেই দাবি পূরণের কোনও ক্ষমতা ও দায় কোনওটাই পথচারীর নেই। তবু অসহায় পথচারীরকেই ভুগতে হয়। এটা কোন ‘শ্রেণি সংগ্রাম’? তাই বামপন্থীদের আন্দোলনের বিকল্প পথ খোঁজার দিন এসেছে। দু’দিন ধরে কর্মনাশা বন্ধ চলছে। আমজনতার ভোগান্তি বাড়ানো ছাড়া এর আর কী কোনও মানে আছে!
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী। তাঁর উপলব্ধি ছিল, বন্ধে আজ আর সাধারণ মানুষ সাড়া দেয় না। বন্ধ কেন ডাকা হয়েছে, কী কী ইস্যু সেই সব কথা সাধারণ মানুষের মধ্যে কত জন জানে? বন্ধে কারও আপত্তি তো থাকতেই পারে। এটা মানুষের স্বাভাবিক ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়। অথচ ভাষণে অবাধ গণতন্ত্রের কথা বলা হয়! এটা তো হতে পারে না। এটা তো ‘সোনার পাথর বাটি’র মতো আজগুবি বিষয়।
রাজনৈতিক দলের এই সব জবরদস্তির বিরুদ্ধে মানুষ মাঝে মধ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। বছর দুয়েক আগের ঘটনা। শিশুর চিকিৎসা করাতে কলকাতা যাচ্ছিলেন সন্তান কোলে এক বাবা। উত্তর ২৪ পরগনার কোনও এক স্টেশনের কাছে রেলের লালগোলা-শিয়ালদহ লাইনে অবরোধ চলছে। এ দিকে অসুস্থ সন্তান যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বাবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। তিনি অসুস্থ সন্তান কোলে নিয়েই ট্রেন থেকে নেমে পড়ে ছিলেন। অবরোধকারীদের ঝান্ডা তিনি নিজে হাতে সরিয়ে দেন। ওই ঘটনা দেখে সহযাত্রীরাও অবরোধ ওঠানোর কাজে শামিল হয়েছিলেন। বামপস্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এটা কিন্ত অশনি সঙ্কেত।
প্রাক্তন সিপিআই নেতা