বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনের শেষ দিনে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি : পিটিআই।
প্রকল্পে টাকা ঢালার আগে শিল্প খোঁজে রাজনৈতিক স্থিরতা, আইনের শাসন এবং লগ্নির নিরাপত্তা। সম্ভবত সে কথা মাথায় রেখেই বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনের দ্বিতীয় তথা শেষ দিনে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, ‘‘স্থিরতা (স্টেবিলিটি) চাইলে, বাংলায় তা আছে। বাংলা নিরাপদ এবং স্বচ্ছ।’’ একই সঙ্গে, তাঁর আহ্বান, ‘‘আস্থা রাখুন, বিনিয়োগ করুন, বাংলা নিরাশ করবে না।’’
লগ্নি টানতে রাজ্যে আইনের কড়া শাসন যে জরুরি, শিল্প সম্মেলনের মঞ্চ থেকেই বুধবার তা মনে করিয়ে দিয়েছেন রাজ্যপাল। বলেছিলেন, ‘‘... লগ্নিকারীরা চান রাজনৈতিক স্থিরতা, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ প্রশাসন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং আইনের শাসন।’’ তোলাবাজি, সিন্ডিকেট-সহ সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ করে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য সরকারকে নিয়মিত বিঁধছেন বিরোধীরা। এই পরিস্থিতিতে শিল্পের মঞ্চ থেকে শিল্পমহলকে মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তা তাই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন প্রশাসনিক মহলের অনেকে।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী অবশ্য এ দিনও বলেছেন, ‘‘শুধু উৎসবের মতো একটি সম্মেলন করে কিছু বিনিয়োগের অঙ্ক দাবি করলেই তো হল না। শিল্পের জন্য আইনশৃঙ্খলার সুস্থ পরিবেশ, প্রশাসনের স্বচ্ছতা, নীতির স্থায়িত্ব এবং সরকারের স্পষ্ট অবস্থান দরকার হয়। এখানে সে সব কোথায়?’’ পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কটাক্ষ, “বেঙ্গল ফর বিজনেস নয়, বেঙ্গল ফর বোমা!’’
বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, যে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেছেন, তাতে তো পুলিশ-প্রশাসনের উপরে তাঁর সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি রাজ্যে ‘নিরাপত্তা ও স্বচ্ছ প্রশাসনের’ ইঙ্গিত দেয় কি? বিধায়কের গুনতিতে রাজনৈতিক স্থিরতা নিয়ে এই মুহূর্তে যে প্রশ্ন নেই, তা মানতে বাধ্য বিরোধীরাও। কিন্তু সুজনই যেমন বলছেন, ‘‘তৃণমূল তৃতীয় বার বিপুল আসন নিয়ে (ক্ষমতায়) ফেরার পরে এক বছরের মধ্যে রাজ্যে অশান্তি তো আরও বেড়েছে! আইনের শাসন নেই। কোথায় সুস্থ পরিবেশ!’’
প্রশাসনিক মহলের অনেকে অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শিল্পমহলের উপরে আঁচ এলে, তা বরদাস্ত করেনি রাজ্য। হলদিয়ার কিছু সমস্যা নিয়ে এক শিল্পপতি অভিযোগ করার পরেই পুলিশ শাসকদলেরই অভিযুক্ত নেতাকে গ্রেফতার করে। মমতারও বার্তা ছিল, যে-ই জড়িত থাকুক, প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ করবে।
লগ্নির লক্ষ্যে স্থিরতা ও নিরাপত্তা বার্তার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ঘোষণা করেছেন বিনিয়োগ-প্রক্রিয়া মসৃণ করতে বাড়তি পদক্ষেপও। যেমন, এই সম্মেলনের আগে শিল্পের ছ’টি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বেছে নিয়েছিল রাজ্য। মমতা জানিয়েছেন, তার প্রত্যেকটি থেকে শিল্প ও বণিক মহলের প্রতিনিধি এবং সরকারি অফিসারদের নিয়ে তৈরি ‘সেক্টরাল কমিটি’ প্রতি মাসে শিল্প নিয়ে পরিকল্পনা-পরামর্শ দিতে একটি করে বৈঠক করবে। মুখ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স কমিটিগুলিকে সহযোগিতা করবে। সবের উপরে থাকছে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন শিল্পোন্নয়ন পর্ষদ। জোর দেওয়া হচ্ছে এক-জানলা সমাধানেও।
লগ্নি টানতে পরিকাঠামোর পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা এবং সম্প্রীতি যে তাঁর তাস, সে কথা আগের দিনই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মমতা। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী ফের বলেছেন, ‘‘আমরা বুলডোজ় করতে চাই না। আমরা রেসপন্স করতে চাই। মানুষকে ভাগ করি না, একত্রিত করি।’’ জহাঙ্গিরপুরীর ঘটনার প্রেক্ষিতে এই মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ ঠেকেছে রাজনৈতিক মহলের বড় অংশের কাছে। সেই সঙ্গে সম্মেলনের শেষ দিনে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ‘‘বিনিয়োগ করুন, বাংলা নিরাশ করবে না। এক নম্বর গ্রোথ সেন্টার (বৃদ্ধির ক্ষেত্র) হল এই রাজ্য।’’