চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কের গায়েই বিডিও অফিস। মোটরবাইকটা পাশের একটা গলিতে রেখে আমি আর সঙ্গী ফটোগ্রাফার হাঁটতে-হাঁটতেই অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। রোদ চড়ছে, প্রায় এগারোটা বাজে। বিডিও অফিসের বড় গেটটা বন্ধ, পাশে ছোট্ট একটা গেট খোলা রয়েছে। দেখলাম ছায়া খুঁজে সব পুলিশ কর্মী অফিসের ভিতরে। বিডিও অফিসের বাইরেটা দখল নিয়েছে প্রচুর লোক।
অধিকাংশেরই মুখ চিনি না। প্রত্যেকের হাতে খেটো লাঠি, দু-এক জনের উইকেট। এ দিক ও দিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে খান কয়েক টোটো।
বিডিও অফিসের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা বরুয়া কলোনির দিকে চলে গেছে। একটু ছায়া খুঁজতে সে দিকে দু’পা হাঁটতেই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, বিজেপি-র বেলডাঙা বিধানসভা পর্যবেক্ষক অলোক ঘোষ গলি দিয়ে আসছেন। লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড় থেকে জনা চল্লিশ লোক রেরে করে তাঁর দিকে তেড়ে গেল। নিমেষে লাঠির ঘা পড়তে থাকল তাঁর উপরে। চোখের সামনে লাঠি পেটা হতে দেখে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ছবি তুলতে শুরু করেছিলাম। তত ক্ষণে বিজেপি কর্মীকে পিটিয়ে ওরা ফিরে আসছে। হঠাৎ খেয়াল হল ছবি তুলছি আমি, এক জন চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘এই ছবি তুলছিস কেন রে, মার ব্যাটাকে!’’
কিছু বুঝে ওঠার আগে বাঁশ-লাঠি-উইকেট পড়তে থাকল আমার পিঠে, মাথায়, পায়ে, হাতে। পালাতে গিয়ে পড়ে গেলাম। ডান হাতের কনুইয়ের পাশে একটা বাঁশের ঘা এসে লাগতেই হাতটা অবশ হয়ে ঝুলতে থাকল। মোবাইলটা ছিটকে কোথায় চলে গেল। চশমা, ঘড়ি, টুপি— ততক্ষণে সব কোথায় ছিটকে গিয়েছে। আর পারছি না, মাথাটা অবশ হয়ে আসছে, তখনও অনর্গল ঘুসি, চড়, লাথি পড়ছে পেটে-বুকে-মাথায়। যারা মারছিল সবাই অল্পবয়সি, ২০-২৫ বছর বয়স। এক সময় ওরা মার থামিয়ে চলে যাচ্ছিল, আচমকা অন্য দিক থেকে ওদেরই আরেকটা দল চলে এলো। এ বার বাঁশের বাড়ি পড়ল আমার পিঠে, কোমরে। মুখ থুবড়ে ফের মাটিতে পড়ে গেলাম। মাথাটা তুলতে যাব, মাথার পিছনে সজোরে একটা লাঠির ঘা পড়ল। চার দিক অন্ধকার হয়ে গেল। হাত দিতেই বুঝলাম মাথার পিছনটা ভিজে। বুঝলাম রক্ত ঝরছে। পড়ে থাকলে আরও মারবে। কোনও রকমে উঠে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলাম। পা চলছে না। তাও ছোটার চেষ্টা করছি। আমার রক্তমাখা অবস্থা দেখে বরুয়া কলোনির এক জন আমাকে টেনে নিজের বাড়িতে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ওঁর জন্য আজ বেঁচে গেলাম। ওঁদের ঘরে ঢুকেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। প্রায় আধঘণ্টা পরে জ্ঞান ফিরল। ওঁদের ফোন থেকে অফিসে ফোন করে জানালাম।
আমার বহরমপুরের সহকর্মীদের কাছেও খবরটা পৌঁছে গেছে ততক্ষণে। ওঁরাই ফোন করে স্থানীয় থানার ওসি সমীর তালুকদারকে বরুয়া কলোনিতে পাঠালেন। আমাকে যখন পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছে অবাক হয়ে দেখলাম লাঠি হাতে সেই লোকগুলো নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। পুলিশকে তোয়াক্কাই করল না। পুলিশও তাদের নিয়ে মাথা ঘামাল না। পুলিশের ভ্যানে ঝিমোতে ঝিমোতে হাসপাতালের দিকে চললাম। জামাটা রক্তে ভিজে সপসপ করছে।