পাথরপ্রতিমা থেকে গোপালনগর যাওয়ার তিনটি পথ— একটি ক্ষেত্রে কিছুটা মোটরভ্যানে, তারপর বেশ খানিকটা পথ, মাঝে একটা বাঁশের অস্থায়ী সেতু। দ্বিতীয় পথও বন্ধ, রাস্তায় কাজ চলছে, সুতরাং হাঁটাও দুরূহ। অগত্যা, রাস মোড় থেকে স্কুলপাড়া, একটু ঘোরাপথ, তবে একমাত্র রাস্তা। এ রাস্তা নিশ্চয় ভাল হবে এ আশা নিয়ে অপেক্ষা করতে হল আধ ঘণ্টা, ‘একটা ভ্যান ইতিমধ্যে এ রাস্তায় ঢুকেছে, ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা যাত্রা শুরু করতে পারব না’, জানালেন ভ্যানচালক। ভ্যানের অপেক্ষায় মোড়ের চা দোকানে দেখা বছর ষাটের সাত্তার সাহেব, সঙ্গে ছোটবেলার বন্ধু অজিতের সঙ্গে। গন্তব্য জানতে পেরে দু’জনেরই এক রা, “গ্রামে পৌঁছতে মেলা টাইম লাগবে।” ‘‘দেখছেন তো সকালের একপশলা বৃষ্টিতে রাস্তার কী অবস্থা’’, অজিতের যোগ। ভ্যান চলে চলে রাস্তায় খানাখন্দ অনেক, খানিক পথ আমরা আগে, ভ্যান পিছু পিছু, অনেকটা পথেই ভ্যানকে জোরে ঠেলা দিলে তবেই সে এগোচ্ছে। অথচ ফি বছর ঘটা করে রাস্তা সারানোর কাজে পঞ্চায়েত, পার্টি ও কন্ট্রাক্টর লেগে পড়ে। ‘‘আচ্ছা বলুন তো এ রাস্তা কী দিয়ে মেরামত করা হয়?’’ শুনছি তো গ্রামীণ রাস্তার মেরামতের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ থাকে, তা হলে থুথু দিয়ে ছাতু গোলার মতো রাস্তা সারালে তো এই অবস্থাই হবে।
গবেষণার কাজে গ্রামে অনেক মানুষের সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ হয়, দেখা যায় তাঁরা কথা বলতে চাই কিন্তু ‘নেতাদের কি কথা শোনার অভ্যাস আছে?’ বা ‘এমন দৃশ্য দেখেছেন যেখানে নেতারা শুনছেন আর আমরা কথা বলছি?’ সাত্তার সাহেবর এই প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই আর এক প্রতিবেশীর প্রশ্ন। মহাত্মা গাঁধী গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের কাজ করে দীর্ঘ দিন মজুরি না পাওয়া যেন স্বাভাবিক। রাজ্যের পিছিয়ে পড়া কয়েকটি জেলায় মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একশো দিনের কাজের কথা মেয়েদের মুখে ঘুরে ফিরে এসেছে। তাঁদের ‘মন কি বাত’: একশো দিনের কাজ কি একেবারে বন্ধ? গত বছরের বকেয়াটা পাব তো? গত বছরে ঘটা করে রোপণ করা গাছগুলি এ বারের গ্রীষ্মকালের তীব্র দাবদাহে সব পাতা ঝরে গাছতলে। ভরসা এখন শুধুই বর্ষা। “একশো দিনের কাজ করেছি ছ’মাস হয়ে গেল। কবে টাকা ব্যাঙ্কে জমা পড়বে, আধার-মাধার সবই তো দিলাম’’, জানালেন মোমেন মিয়া। বা ডোমকল ব্লকের বছর ষাটের বিধবা জামিলার অবস্থা আরও করুণ। আমগাছের তলায় এক মনে রেশমের গুটি থেকে সুতো বের করে দিনে আয় করবে কুড়ি টাকা, গৃহহীন আর কি প্রমাণপত্র লাগবে বাংলার আবাস যোজনার এক জন উপভোক্তা হতে?
প্রশ্নের তালিকা লম্বা, উত্তর দীর্ঘ নীরবতা। এ প্রশ্নের উত্তর জানলে তাঁদের জীবনের মানোন্নয়ন হত, সঙ্গে গণতন্ত্র সত্যিই গণমুখী হত। গাঁধীজি ‘গ্রাম স্বরাজ’-এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র অনুশীলনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা খানিক বর্তমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। আইনে অবশ্য বিধান আছে পঞ্চায়েত এলাকায় বসবাসকারী সব নাগরিকেরই উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার হক আছে। এ জন্য সেই নাগরিককে আলাদা করে কাঠখড় পোড়াতে হবে না। পঞ্চায়েত আইনে গ্রাম সংসদ গঠন ও নিয়মিত সভার আয়োজনের কথা উল্লেখ আছে। এই সভা আদতে রাজ্যে প্রান্তিক মানুষটিরও নির্ভয়ে কথা বলার পাটাতন। পঞ্চায়েত আইন অনুসারে গ্রাম সংসদের সভায় গত আর্থিক বছরের আয় ও ব্যয়ের হিসাব পেশ করতে হবে। রাজস্ব বাবদ কত টাকা পঞ্চায়েতে জামা পড়েছে তা-ও গ্রামবাসীকে জানাতে হবে। এই সভাতেই জানা যাবে সরকারি নানা প্রকল্পে কত টাকা গ্রামের জন্য বরাদ্দ আর কত টাকা খরচ হয়েছে বা কারা এই প্রকল্পের প্রকৃত উপভোক্তা ও সেই পরিবারগুলো কী কী ধরনের সুবিধা পেয়েছে। এই সভার ফলে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে রূপায়িত উন্নয়নমূলক সরকারি প্রকল্পে সাধারণ নাগরিকের গঠনমূলক অংশগ্রহণ বেড়ে যেত।
গণতন্ত্রকে প্রকৃত অংশগ্রহণমুখী করে তোলা, এ ছাড়াও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি করতে পারার জন্য দীর্ঘ জন আন্দোলনের ফলে ২০০৫ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রচলিত হয়। এ আইনের চার নং ধারা আবার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নাগরিকেরদের তথ্য দেওয়ার বিধান দিয়েছে। এই আইন চালু হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যেই পঞ্চায়েত সমিতি তার সরকারি সমস্ত তথ্য ভাণ্ডার সংরক্ষণ করবে ও কিছু তথ্য প্রকাশ করবে। এই আইন অনুযায়ী পঞ্চায়েত সমিতির সমস্ত ধরনের তথ্য তালিকা তৈরি করে সাজিয়ে রাখতে হবে যাতে এই আইন অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ মসৃণ ভাবে করা যায়। কম্পিউটারে তথ্য সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কম্পিউটারে সংরক্ষিত তথ্য নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সরবরাহের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তথ্য অধিকার আইন বলে এক জন সাধারণ নাগরিকেরও ক্ষমতা আছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সব কিছু খুঁটিয়ে দেখার।
পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রূপায়িত সরকারের সমস্ত প্রকল্পের সঠিক রূপায়ণে ‘পাঁচ জনের নজরদারি’ (সোশ্যাল অডিট) খুবই কার্যকারী পদক্ষেপ। মহাত্মা গাঁধী গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা আইনে ‘সোশ্যাল অডিট’-এ খুব জোর দেওয়া হয়েছে। এই ধারার নিয়মিত অনুশীলনে দেশের অন্যত্র, বিশেষ করে তেলঙ্গানাতে একশো দিনের কাজে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বেড়েছে। এই রাজ্যে পরিকাঠামো সর্বস্ব উন্নয়নের ঢক্কানিনাদে কোথায় যেন একটা চাপা স্বর: নেতারা কী ভাবে এত ফুলেফেঁপে উঠছেন?
রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে রাজ্যবাসীর একটা শ্লাঘাবোধ কাজ করে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়মিত হয়েছে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাও তৈরি হয়েছে, বা সংরক্ষণের সুযোগ থাকায় মহিলা, তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু আমরা কি হলফ করে বলতে পারি, পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে? অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে পঞ্চায়েত দরওয়াজা হাট করে খুলে দিতে হবে, মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সবার জন্য হবে।
প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার ও জবাবদিহির অভাবে দেশের নাগরিকেরা কেমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই কম-বেশি আছে, আর দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষজনের উপর এর প্রভাব বেশি লক্ষিত, বিশেষ করে মহিলাদের উপর। তথ্য অধিকার আইনের বলে পিছিয়ে পড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামেরও এক সাধারণ মহিলা আজ প্রশ্ন করতে পারেন। জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন, “এই আইনের পরিধি ও গভীরতা আরও অনেক বাড়ানোর সুযোগ আছে, বিশেষ করে ‘স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য উন্মোচন’-এর বিধান আছে, সেটি অনেক বেশি করে প্রয়োগ করা দরকার।”
রাজ্য সরকারের সাফল্যের গুণগান করতে বিভিন্ন দফতর কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, অথচ নাগরিকদের একটা বড় অংশই জানেন না, তথ্য জানাও তাঁদের অধিকার। নারগিসদের অন্ধকারে রাখার মধ্যে লুকিয়ে আছে শাসকের দীর্ঘ দিনের লালিত ক্ষমতা। আমাদের এই সব প্রশ্নের উত্তর যদি পঞ্চায়েত না দেয়, পাথরপ্রতিমার এক মহিলার প্রশ্ন: তা হলে কি পঞ্চায়েতও পাথর প্রতিমা?
(লেখক প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত)