নবান্নে বৈঠক শেষে এনআরএসে ফেরার পরে জুনিয়র ডাক্তারদের উচ্ছ্বাস। সোমবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সকাল থেকে বাস দাঁড় করানো ছিল অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ের পাশে। সোমবার বিকেলে ৩১ জন আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের নিয়ে সেই বাস যখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ চত্বর ছাড়ল তখনও চার পাশে সতীর্থরা আওয়াজ তুলছেন, ‘আমরা কারা? বহিরাগত।’ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস!’ আড়াই ঘণ্টা পরে সেই স্লোগানই বদলে হল, ‘জিতল কারা? লক্ষ্মীছেলে! থাকবে কারা? লক্ষ্মীছেলে!’ নবান্নের চোদ্দো তলায় এক ঘণ্টার ‘লাইভ’ বৈঠক শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘লক্ষ্মীছেলে আমার, কাজে যোগ দাও।’’ সেই সূত্রেই নতুন স্লোগান।
এনআরএসে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনায় রাজ্য জুড়ে স্বাস্থ্য পরিষেবায় যে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, তা মেটাতে গত সাত দিন ধরে নবান্ন, স্বাস্থ্যভবন এবং এনআরএস কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনে কম বৈঠক হয়নি। রবিবার রাতে রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, এ দিন বিকেল তিনটে নাগাদ ১৪টি মেডিক্যাল কলেজের দু’জন করে প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে চিকিৎসকেরা লাইভ ক্যামেরায় বৈঠকের যে দাবি তুলেছিল, তাতে আপত্তি ছিল নবান্নের।
এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে এনআরএসের প্রশাসনিক ভবনের অডিটোরিয়ামে গভীর রাত পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। সকাল সওয়া ১০টা নাগাদ সাংবাদিক বৈঠক করে জুনিয়র চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, মিডিয়ার উপস্থিতিতেই তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক চান। জানান এ দিনের বৈঠক নিয়ে তখনও কোনও সরকারি চিঠি তাঁরা পাননি। বস্তুত, এই সাংবাদিক বৈঠকের পরে নতুন করে জটিলতার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এর পরে সাড়ে ১১টা নাগাদ আন্দোলনকারীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নবান্নের বৈঠকে যোগদানের আর্জি সংক্রান্ত চিঠির প্রতিলিপি পোস্ট হয়। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের সই করা চিঠিতে বলা হয়, ‘বৈঠকে যা-ই আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা যথাযথ ভাবে নথিভুক্ত করা হবে’। প্রতিনিধির সংখ্যা ২৮ জন। কিন্তু লাইভ বৈঠক ছাড়া তাঁরা যাবেন না, এ কথা আর এক বার আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট করে দেন। একই সঙ্গে প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়িয়ে ৩১ করার কথা বলা হয়।
এই পরিস্থিতিতে এনআরএসে আসেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা। এনআরএস সূত্রের খবর, প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আপত্তি ওঠেনি। তবে প্রদীপবাবু জানান, মিডিয়ার উপস্থিতিতে বৈঠক সরকার মানবে কি না, তিনি নিশ্চিত নন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তিনি বলতে পারবেন। বৈঠক রেকর্ড করে পরে তা সম্প্রচারিত করার একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা আন্দোলনকারীরা খারিজ করে দেন। মুখ্যমন্ত্রী যে লাইভ কভারেজে সম্মতি দিয়েছেন, দুপুর দুটোর পরে তা চিকিৎসকদের লিখিত ভাবে জানিয়ে দেন এনআরএসের অধ্যক্ষ শৈবাল মুখোপাধ্যায়। করতালিতে ফেটে পড়ে প্রেক্ষাগৃহ। এর পরেই নবান্ন যাত্রার উপচারিতা শুরু হয়ে যায়।
প্রশাসনিক ভবনের একতলায় হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পুলিশকর্মীরা। তার মাঝ দিয়ে হেঁটে প্রতিনিধি দলের সদস্যেরা বাসে যখন উঠলেন তখন মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি নিয়ে অনেক প্রবীণ চিকিৎসককেই বলতে শোনা গেল, ‘‘আমরা যা পারিনি, ছেলেগুলো করে দেখাল।’’ বাস হাসপাতাল চত্বর ছাড়ার পরই লাইভ বৈঠক দেখার জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সাতদিন যে অডিটোরিয়ামে একের পর এক সাধারণ সভা হয়েছে, সেখানে প্রজেক্টর এবং ধর্না মঞ্চে টেলিভিশন বসিয়ে নবান্নের বৈঠক দেখানোর ব্যবস্থা হয়।
এনআরএসের অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সুষ্ঠু পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সমস্যা রয়েছে, জুনিয়র চিকিৎসকেরা তা মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছেন। এটা জরুরি ছিল।’’ এসএসকেএমের যুগ্ম অধিকর্তা অর্পিতা রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত আমার জুনিয়র ভাইয়েরা আন্দোলনে রাজনীতির রং লাগতে দেয়নি। তাই আন্দোলন সফল হল।’’ স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টা ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। সকলে চেয়েছিলাম পরিষেবা চালু হোক। এখন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়।’’