‘পাতাল লোক ২’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে জয়দীপ আহলাওয়াট এবং ইশ্বাক সিংহ। ছবি: সংগৃহীত।
অ্যামাজ়ন প্রাইমে ক্রাইম থ্রিলার ‘পাতাল লোক’-এর প্রথম সিজ়ন যখন সম্প্রচার হয়, তখন কোভিডকাল। ২০২০ সালের লকডাউনের মাঝে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছন মধ্যবিত্ত পুলিশ আধিকারিক হাতিরাম চৌধরি ওরফে জয়দীপ আহলওয়াট। বিশেষ খ্যাতি পান বাংলার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হাতোড়ি ত্যাগী’র ভূমিকায় তাঁর হিমধরানো অভিনয়ের জন্যে। সেই বহুল আলোচিত সিরিজ়ের দ্বিতীয় পর্ব বেরোল ২০২৫ সালে।
এই ক’বছরে ‘পাতাললোক’-এর মতো সিরিজ়ের জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখে সেই একই ফ্রেমে বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এসেছে অসংখ্য ক্রাইম থ্রিলার। তাই সিরিজ়টি দেখতে বসার আগে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জেগেছিল, আখ্যান-কাঠামো অভিন্ন রেখে চরিত্রের বদল ঘটিয়ে একের পর এক হয়ে চলা তদন্তের মাঝে ‘পাতাললোক: সিজ়ন ২’ কি আদৌ দর্শককে নতুন কিছু দিতে পারবে?
‘পাতাল লোক ২’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে জয়দীপ আহলাওয়াট। ছবি: সংগৃহীত।
‘পাতাল লোক’-এর এই সিজ়নে কাহিনি দিল্লির সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বে। প্রেক্ষাপট নাগাল্যান্ড। যদিও সংঘটিত অপরাধের প্রাথমিক সূত্র আটকে রয়েছে দিল্লিতেই। প্রথম সিজ়নের মতো এখানেও গল্পের বড় অংশ হাতিরাম এবং তার এক রহস্য থেকে আর এক রহস্যে জড়িয়ে পড়ার অদ্ভুত সংযোগকে ঘিরে ডানা মেলে। পরিবার এবং জীবিকার দ্বন্দ্বে জর্জরিত হাতিরামের থানায় হঠাৎ এসে হাজির হয় এক মহিলা, সঙ্গে বছর পাঁচেকের একটি ছেলেকে নিয়ে। কিছু দিন ধরে তার স্বামী রঘুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। থানার অন্য পুলিশেরা মহিলাকে পাত্তা না দিলেও হাতিরাম ন্যায়নিষ্ঠ, বালক গুড্ডুর বাবাকে সে উদ্ধার করে আনবেই। অন্য দিকে দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য নাগাল্যান্ড বিজ়নেস সামিটের আগের দিন ঘটে যায় এক ভয়ঙ্কর হত্যা। গুড্ডুর বাবাকে খুঁজতে বেরিয়ে হাতিরাম সন্ধান পায় এমন কিছু বিষয়ের, যা প্রভাব ফেলতে পারে দিল্লি এবং নাগাল্যান্ডের সম্পর্কে। একগুঁয়ে পুলিশ ইনস্পেক্টরটির সহকারী বা বন্ধু ‘সাব-ইনস্পেক্টর’ আনসারি ফিরে আসে আইপিএস হয়ে এসিপি অবতারে। গল্প এগোয় মাদক চক্র, অর্থনীতি, রাজনৈতিক টানাপড়েন, ঔদ্ধত্য এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। এ গল্প শুধু রহস্যের উন্মোচন করে না, অনুসন্ধান করে উত্তর-পূর্ব ভারতের অতীত এবং বর্তমান, দলীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ এবং নেতৃত্বের ঠিকভুল-জাতীয় বহমান সমস্যাগুলির শিকড়ের।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
ক্রাইম থ্রিলার জ়ঁরের সুবিধা এবং অসুবিধা দু’টিই হল গল্পের চলন। কাহিনির গাঁথুনি যদি হয় বেগবান এবং ফাঁকহীন, তবে সেটিই দর্শককে টেনে নিয়ে যাবে এক রহস্য থেকে আর এক রহস্যের কিনারায়। অবিনাশ অরুণ দক্ষ পরিচালক, ক্রাইম থ্রিলার জ়ঁর তাঁর দক্ষতার ক্ষেত্র। মেদহীন চিত্রনাট্যে কোনও বাড়তি দৃশ্যের অবতারণা নেই। বরং অবিনাশ এবং সুদীপ শর্মা খেলা করেছেন চিত্রনাট্য নিয়ে। নানা দৃশ্যে যে ছড়িয়ে-পড়া সূত্রগুলি রয়েছে, তার সব ক’টিকেই জুড়েছেন শেষে। দর্শককে সুযোগ দিয়েছেন বার বার, সমাধানের পথ দেখিয়েছেন। সংলাপ, আবহসঙ্গীত এবং চিত্রগ্রহণও ব্যাকরণ মেনে এগিয়েছে। একটি বাণিজ্যিক ক্রাইম থ্রিলারের ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত, তার সব উপাদান মাপসই ভাবে হাজির এই সিরিজে। আবেগ-তরঙ্গের উত্থান-পতনেও সুদীপ শর্মা সুন্দর কৌশল অনুসরণ করেছেন। তিলোত্তমা সোম, ইশ্বাক সিংহ, জহ্নু বড়ুয়া যথাযথ। ছোট চরিত্রে সুদীপ মুখোপাধ্যায়কে দেখে ভাল লাগল। এক কথায়, সপ্তাহান্তে বাড়িতে বসে ছুটি কাটাতে হলে অ্যামাজ়ন প্রাইমে ‘পাতাল লোক সিজ়ন ২’ দেখার জন্য রাত জাগা যেতেই পারে।
কিন্তু যাঁরা শুধু দেখতে নয় ভাবতেও ভালবাসেন, তাঁদের জন্য এই সিরিজ় নতুন কি কিছু দিতে পারল? এ সিরিজ়ে সব কিছুই খুব মাপা, ব্যাকরণ মেনে দর্শক টেনে রাখার কৌশল। ‘সেক্রেড গেমস’ বা ‘পাতাল লোক সিজ়ন ১’-এর মতো মাইলস্টোন হয়ে উঠতে পারল না এই সিরিজ়। এই সিরিজ় উপভোগ্য হলেও বিস্ময় জাগায় না। আর মানুষ বিস্মিত না হলে সেই শিল্প বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে বেশি সময় নেয় না। ‘হাতোড়ি ত্যাগী’কে নিয়ে দর্শকের মধ্যে আজও যে উত্তেজনা বর্তমান, সেই একই উত্তেজনা ‘পাতাল লোক’-এর নতুন সিজ়ন নিয়ে থাকবে তো পাঁচ বছর পরও! সত্যি বলতে, হাতিরামের পাশাপাশি বলিষ্ঠ কোনও নতুন চরিত্রই উঠে আসেনি এই সিজ়নে।
‘পাতাল লোক ২’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে তিলোত্তমা সোম। ছবি: সংগৃহীত।
তা বলে কি কোনও প্রাপ্তিযোগই নেই এই সিজ়নে? উত্তর হল— আছে। আছেন খোদ জয়দীপ আহলওয়াট, হাতিরামের চরিত্রে তিনি যেন আরও ক্ষুরধার, আরও বেশি করে বাস্তব হয়ে উঠেছেন। প্রতি মুহূর্তে তাঁর অভিনয় দক্ষতা যেন তাঁর আগের উদাহরণগুলিকেও ছাড়িয়ে গেছে। শরীরের প্রতিটি অংশকে ব্যবহার করেছেন নিখুঁত ভাবে। আর আছে নাগাল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সেখানকার মানুষ। উত্তর-পূর্বের এই ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতিকে তুলে আনা এবং তাকে ঘিরে গল্প তৈরির দরকার ছিল। অবিনাশ এবং সুদীপকে ধন্যবাদ এমন একটা প্রেক্ষাপটকে জনপ্রিয় সিরিজ়ে প্রয়োগ করার জন্য।