West Bengal Panchayat Election 2023

হিংসাই কি পরম্পরা, ফের চর্চায় বঙ্গের ভোট

বিভিন্ন ঘটনার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করলেও রাজ্যের প্রথম সারির সব দলের নেতারাই মেনে নিচ্ছেন, হিংসার এই ‘সংস্কৃতি’ই বয়ে চলেছে বছরের পর বছর।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩৪
Share:

বাক্সে ব্যালট পেপার ফেলছেন, অভিযোগ ভোটকর্মী রমেন সর্দারের বিরুদ্ধে। নদিয়ার আড়ংঘাটার একটি বুথে শনিবার। ছবি: সুদেব দাস।

নন্দীগ্রামে সোনাচূড়ার রাস্তায় সিআরপিএফের আধিকারিকের গাড়ি থামিয়ে কাতর আর্তি জানাচ্ছিলেন এক মহিলা। ভোট দিতে বেরিয়ে শাসক বাহিনীর তাড়া খেয়ে ঘুরে বেড়ানো অসহায় মুখ। তাঁর বুথ দখল হয়ে গিয়েছে। সেই বুথে বাহিনী পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে আধা-সামরিক বাহি্নীর কর্তা সে দিন জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘কী ব্যাপার বলুন তো আপনাদের এখানে? বিহার, উত্তরপ্রদেশে গ্রামে জল বা বিদ্যুতের জন্য মানুষ হা-পিত্যেশ করে থাকে। আর এখানে ভোটের দিনে লোকে সেই ভাবে বাহিনী চায়!’’

Advertisement

দিনটা ১৫ বছর আগের। সে দিনও বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট। রাজ্যে ক্ষমতায় তখন সিপিএম।

দেড় দশক পরের পঞ্চায়েত ভোটের দিন মুর্শিদাবাদের রঘুনাথতলার বাসিন্দা এক মহিলার হাতে লেখা আবেদনপত্র নজরে এল। বহরমপুর থানার আইসি-কে ৮ জনের নাম জানিয়ে তিনি অভিযোগ করছেন, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ওই হামলাকারীরা তাঁর জামা-কাপড় ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে মারধর করেছে এবং তাঁকে বার করে দিয়ে বুথ দখল করেছে। ওই বুথে কংগ্রেসের এজেন্ট ছিলেন মহিলা।

Advertisement

নির্বাচনের দিন রাজ্য জুড়ে তাণ্ডব, রক্তপাত, প্রাণহানি, ভোট-লুটের খবরের বাঁধভাঙা স্রোতের মাঝে ১৫ বছরের ব্যবধানে দুই মহিলার বিপন্নতার দুই টুকরো ছবি সেই প্রশ্নটার সামনে আবার এনে দাঁড় করিয়ে দিল! কেন বাংলায় বারবার এমন হয়? কেন বাংলাতেই এমন হয়? উত্তরপ্রদেশে সদ্য ১৭টা নগর পালিকার ভোট হয়ে গিয়েছে। ফল ঘোষণার আগে বাইরের কেউ টেরও পায়নি যে, ভোট হয়েছে! কর্নাটকে বিধানসভা নির্বাচনের আগে নগর পরিষদের ভোট হয়েছে। বিহার, মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানেও স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন হয়। হিংসার জন্য সে সব রাজ্য শিরোনামে আসে না। কিন্তু বাংলা বারেবারে আসে!

নানা মহলে কথা বলে বাংলার এমন ‘হিংস্র পরম্পরা’র নেপথ্যে মূলত তিনটি কারণ উঠে আসছে। প্রথমত, রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এই হিংস্রতার যোগসূত্র আছে। বাংলায় যত বেশি মানুষের রোজগার সরাসরি রাজনীতি থেকে হয়, অন্য রাজ্যে তেমন নয়। পরিযায়ী হয়ে ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে বাংলায় নিজেদের পুরনো মুলুকে হিংসা-হানাহানির কারবার থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছেন, এমন মানুষের সন্ধান এখন পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জঙ্গি মনোভাবের ছাপ না থাকলে রাজনীতিতে দাগ কাটা যায় না, এই সংস্কৃতি এ রাজ্যে দীর্ঘলালিত। আর তৃতীয়ত, পুলিশ-প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে সাধারণ আইনশৃঙ্খলাকে অবহেলা করার প্রবণতাও নাছোড়।

বিভিন্ন ঘটনার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করলেও রাজ্যের প্রথম সারির সব দলের নেতারাই মেনে নিচ্ছেন, হিংসার এই ‘সংস্কৃতি’ই বয়ে চলেছে বছরের পর বছর। এবং এই হিংসার গ্রাস থেকে মুক্তির আশা এবং দিশা, কোনওটাই কার্যত তাঁদের নেই!

রাজ্যের মন্ত্রী ও বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের মতে, খুনোখুনির রাজনীতি শুরু হয়েছিল গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি। তার আর শেষ হয়নি। শোভনদেবের কথায়, ‘‘বিষবৃক্ষ পুঁতলে তার ফল তো এই রকমই হবে! সেই সময়ে যেটা শুরু, তার পরে কংগ্রেসের সরকার এসেছে। তার পরে সিপিএমের ৩৪ বছরে যত গণহত্যা হয়েছে, তার নজির তো ঐতিহাসিক! যে বীজ পোঁতা হয়েছিল, তার ফল নানা দিকে ছড়িয়ে আছে। মানুষের সচেতনতা না বাড়লে এর থেকে মুক্তি নেই।’’ রাজনীতিতে অর্থের সন্ধান যে দখলদারি এবং গা-জোয়ারি বাড়িয়ে দিয়েছে, পঞ্চায়েতের উদাহরণ টেনেই সেই প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতা বলছেন, ‘‘গ্রাম পঞ্চায়েত আর জেলা পরিষদের প্রার্থী হতে চায় সবাই এই কারণে।’’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘মানুষের অভাবকে রাজনীতির সওদা করলে এই রকমই চলবে। সেই নকশাল আমল থেকে শুরু করে বাংলার রাজনীতিতে জঙ্গি আন্দোলন বরাবরই বড় জায়গা নিয়ে আছে। আর পুলিশ-প্রশাসন আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় থেকে শাসক দলের হয়ে কাজ করে গেলে কী ভাবে সমস্যার সমাধান হবে?’’ রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘অর্থনৈতিক হাল অবশ্যই একটা বড় কারণ। বাঙালি তার সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে বড় করে দেখে মনে করে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতে কেউ কিছু জানে না! আমরা যা করছি, সেটাই ঠিক। আর কমিউনিস্ট শাসন যেখানে ছিল, সেই বাংলা ও ত্রিপুরায় এই হিংসা বিশেষ বৈশিষ্ট্য!’’ আর সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘লড়ে নিতে হবে, এই মনোভাব প্রাক্-স্বাধীনতা আমল থেকে বাংলায় আছে। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কোনও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’’ তাঁর দাবি, বাম আমলে ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বেলাগাম হিংসা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ ছিল এবং তার নির্দিষ্ট কারণও ছিল। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন কখনও মানুষের পাশ থেকে একেবারে উবে যায়নি!

মতের ফারাক থাকবে। সেই সঙ্গেই নাড়া দিতে থাকবে এই পঞ্চায়েত ভোটের সকালে টিভি চ্যানেলে খবর দেখে ভিন্ রাজ্যের পুলিশ-কর্তার পাঠানো কটাক্ষ-বার্তা— ‘বিপ্লব করতে হয়! নইলে গুজরাত, ইউপি-র মতো পিছিয়ে পড়তে হয়’!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement