প্রতীকী চিত্র।
প্রশাসক প্রতিপালকও। ভারতীয় শাসন ব্যবস্থার নানা বিবর্তনের মধ্যেও সুপ্রাচীন এই আপ্তবাক্য যে অটুট, বিডিও বা ব্লক উন্নয়ন আধিকারিককে পিতৃমাতৃহীন নাবালক ছাত্রের ‘প্রশাসনিক অভিভাবক’ করার ঘটনায় তার প্রমাণ মিলল। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দিতে স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে। শাসনতন্ত্রে এর সংস্থান থাকলেও প্রশাসনে সচরাচর এমন দৃষ্টান্ত মেলে না। এবং সেই জন্যই এই পদক্ষেপ ‘ব্যতিক্রমী’ বলে নবান্নের শীর্ষ মহলের একাংশের অভিমত।
বাড়ি বলতে বাঁশ-দরমা-চট-প্লাস্টিকের ছোট্ট কুঁড়ে। পূর্ব মেদিনীপুরের বছর চোদ্দোর সুবিনয় মল্লিক (নামবদল)-এর সহায় বলতে এক সময় ছিলেন মা-বাবা। সরকারি আবাস যোজনায় পাকা বাড়ির বরাদ্দও পায় পরিবারটি। কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধিতে সুবিনয়ের মা-বাবা দু’জনেই প্রয়াত। সরকারি নিয়মবিধি অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সিদের উপভোক্তা হিসেবে গণ্য করা হয় না। সেই নিয়ম মানতে গেলে সুবিনয়ের সম্বল বলতে আর কিছুই থাকে না। আবার মৃতদের কোনও পরিজনকে টাকা দিতেও ‘ভরসা’ পাননি প্রশাসনিক কর্তারা। অগত্যা বিডিও-কেই সুবিনয়ের ‘অভিভাবক’ করা হয়েছে। ফলে টাকা পেতে আর কোনও সমস্যা নেই। বয়স ১৮ বছর হলে বাড়ির মালিক হবে সুবিনয়।
এক প্রশাসনিক কর্তা বলেন, “খাতায়-কলমে অনেক কিছু বলা থাকে, আবার কিছু থাকেও না। যেগুলি বলা থাকে না, সেখানে নিয়ম না-ভেঙেও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং বুদ্ধি করে পথ বার করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সেটাই করা হয়েছে। জেলায় জেলায় এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যার সমাধান কোনও নিয়মের বইয়ে লেখা থাকে না। তাই জেলা-কর্তাদের কাছ থেকে এমন পদক্ষেপই কাম্য।”
পাকা বাড়ি নেই, এমন অসহায় গরিবদের মাথার উপরে পাকা ছাদের ব্যবস্থা করতে আবাস প্রকল্প চালু রয়েছে দীর্ঘ কাল ধরেই। সব দিক থেকে যোগ্য প্রমাণিত হলে পাকা বাড়ি তৈরির জন্য তিন কিস্তিতে যথাক্রমে ৬০ হাজার, ৫০ হাজার এবং ১০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন উপভোক্তা। এ ক্ষেত্রে উপভোক্তার নিজস্ব জমি থাকতে হয়। তবে নিজের জমি না-থাকলেও সরকার যদি জমি দেয়, সেখানেও বাড়ি তৈরির জন্য বরাদ্দ টাকা মিলতে পারে।
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, এই প্রকল্পের আওতায় পূর্ব মেদিনীপুরের ওই পরিবার বাড়ির বরাদ্দ পেয়েছিল। ২০১২ সালে সুবিনয়ের বাবা এবং দু’বছর পরে তার মা এডস আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার পরে সুবিনয়ের মায়ের নামে বাংলা আবাস যোজনায় বাড়ি বরাদ্দ হয়। সাধারণত, স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কেউ মারা গেলে জীবিত ব্যক্তিকে উপভোক্তা হিসেবে মেনে নেয় সরকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দু’জনেরই মৃত্যু হওয়ায় তাঁদের নিকটাত্মীয় বলতে থেকে যায় শুধু সুবিনয়। কিন্তু তার বয়স ১৮ হয়নি বলেই সরকারি প্রকল্পের উপভোক্তার তালিকায় বাবা-মায়ের বদলে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব ছিল না।
মা-বাবার মৃত্যুর পর থেকে সুবিনয় থাকে কাকার কাছে। পড়ে বাড়ির কাছের একটি স্কুলে। প্রকল্পের টাকা পেতে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন সুবিনয়ের কাকা। কিন্তু তাঁর সেই আবেদন মানতে চাননি জেলা-কর্তারা। জেলাশাসক স্তরে আলোচনা করে স্থির হয়, কাকা নয়, টাকা পাওয়ার অধিকারী একমাত্র সুবিনয়ই। জেলাশাসকের নির্দেশে নাবালক সুবিনয়ের স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে বিডিও-কে নিযুক্ত করা হয়। ঠিক হয়, আবাস যোজনার টাকা বিডিও-র সরকারি অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সুবিনয়ের বাড়ি তৈরির জন্য পঞ্চায়েত সমিতির নিজস্ব তহবিল থেকে আরও ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রান্নাঘর, শৌচাগার, পানীয় জলের ব্যবস্থার পাশাপাশি সুবিনয়ের থাকার জন্য ঘরে আসবাবপত্র এবং পড়াশোনার যাবতীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থাও করবে স্থানীয় প্রশাসন।
বিডিও বলেন, “ওই নাবালকের স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে আমার অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেবে সরকার। সেই টাকায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে সুবিনয়ের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে।”
সহ প্রতিবেদক: গোপাল পাত্র