প্রতীকী ছবি।
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে ‘চিকিৎসা’ করানো মানুষের সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে। খরচ বাবদ রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে টাকাও অনেক বেড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কত জন ‘প্রকৃত’ উপভোক্তা, কত জনের ‘সত্যিকারের’ চিকিৎসা হচ্ছে, এ বার তা সরেজমিনে খতিয়ে দেখায় জোর দিচ্ছে পূর্ব বর্ধমান জেলা স্বাস্থ্য দফতর।
স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড নিয়ে ‘জালিয়াতির’ তদন্তে নেমে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা এ বার ‘ভুয়ো’ কার্ডের ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা ভাবছে। তাঁদের সন্দেহ, প্রকৃত উপভোক্তার কার্ড নিয়ে যদি সব রকম নিয়ম মেনে ‘জালিয়াতি’ করা হয়, তাহলে ‘ভুয়ো’ কার্ড থাকাও অসম্ভব নয়। তাই স্বাস্থ্য দফতর জেলার সমস্ত স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের নথিপত্র ঠিক রয়েছে কি না, তা ঝাড়াই বাছাই করার কথা ভাবছে। বিধিমতো নথিপত্র না থাকলে কার্ড ‘ব্লক’ করে দেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
পূর্ব বর্ধমানের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ) প্রণব রায় বলেন, “প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের কার্ড পরীক্ষা করে দেখা হবে।’’ পাশাপাশি বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতেও অভিযান চালানোর কথা ভাবা হয়েছে। রাজ্যের এক স্বাস্থ্য কর্তার কথায়, “জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতর যৌথ ভাবে স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় থাকা বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিতে আচমকা পরিদর্শন করবে। এতে দু’-একটি নার্সিংহোম বা বেসরকারি হাসপাতাল শাস্তির কোপে পড়লেও কিছু করার নেই।’’ চলতি সপ্তাহেই জেলা প্রশাসন স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প নিয়ে একটি বৈঠক করতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই জেলায় এক সময় সাড়ে ১৫ লক্ষের মতো স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের উপভোক্তা ছিল। এখন ‘অ্যাক্টিভ’ রয়েছে প্রায় ১৪ লক্ষ ৬৯ হাজার কার্ড। যার মধ্যে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনটে দুয়ারে সরকারের শিবিরেই ৭ লক্ষ ২৯ হাজার পরিবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পেয়েছে। ব্যক্তি-উপভোক্তা ধরলে কমবেশি ২৭ লক্ষ মানুষ এই প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপক।
প্রশাসনের পর্যবেক্ষণ, স্বাস্থ্যসাথীর তথ্যভান্ডারে এমন অন্তত কয়েক হাজার উপভোক্তা রয়েছেন, যাঁদের আধার নম্বরের উল্লেখ নেই। আবার কিছু কার্ডে একই আধার নম্বর দেওয়া রয়েছে। তাই প্রকৃত আধার নম্বরযুক্ত কার্ডগুলি চিহ্নিত করতে উদ্যোগী হয়েছে জেলা প্রশাসন।
এক কর্তা বলেন, “দুয়ারে সরকার কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসাথীতে নাম নথিভুক্ত করার জন্য আধার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এমন হতেই পারে যে, আগে নথিভুক্ত উপভোক্তাদের একাংশের কাছে প্রকৃত আধার নম্বর থাকলেও তা নথিবদ্ধ হয়নি। আবার অসাধু উপায়ে কেউ কার্ড পেলে তা-ও চিহ্নিত করা প্রয়োজন।”
জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, মূলত চারটে উদ্দেশে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যাচ্ছে।— এক) স্বাস্থ্যসাথীকে ঘিরে যে ‘জালিয়াতি-চক্র’ গড়ে উঠেছে, তাকে ঠেকানোর প্রয়োজন। দুই) প্রকৃত উপভোক্তাদের কাছে এই প্রকল্পের সুবিধা দ্রুত পৌঁছে দেওয়া। তিন) রোগীকে ‘ডিসচার্জ’ করে দেওয়ার পরেও স্বাস্থ্য দফতরের ‘অনুমোদন’ নেওয়ার নাম করে কার্ড আটকে রাখার প্রবণতা রয়েছে কিছু বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। তা বন্ধ করা প্রয়োজন। চার) সাশ্রয়। অপচয় রোখা গেলেই প্রকৃত প্রাপকদের চাহিদা মেটানোর কাজ সহজ হবে।
প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত জেলায় দু’লক্ষেরও বেশি উপভোক্তা সুবিধা পেয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসার জন্য প্রায় ৩১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গত আর্থিক বছরে ৪৪,৯০১ জনের চিকিৎসার জন্য ৬২ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা খরচ দিয়েছে রাজ্য সরকার। চলতি আর্থিক বছরে প্রায় আড়াই গুণ উপভোক্তা (এক লক্ষ চার হাজার ৬৮৬ জন) স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা নিয়েছেন। খরচও হয়েছে গত আর্থিক বছরের প্রায় তিন গুণ বেশি (১৮৮ কোটি চার লক্ষ টাকা)।
অভিজ্ঞ আধিকারিকদের একাংশের ধারণা, এক বছরের মধ্যে হঠাৎ করে উপভোক্তা বেড়ে যাওয়া, খরচও প্রায় তিন গুণ বেশি হওয়ার পিছনে ‘জালিয়াত-চক্র’র হাত থাকতে পারে। তাঁদের ধারণা, কয়েক হাজার ‘ভুয়ো’ কার্ড বাতিল হলেই বছরে কয়েক কোটি টাকা বাঁচবে। তাই যাতে ‘প্রকৃত’ উপভোক্তাদের কার্ডই থাকে, তা নিশ্চিত করায় জোর দিতে চাইছে স্বাস্থ্য দফতর। এই নজরদারি ধারাবাহিক ভাবে চালানো দরকার। ‘সিঙ্গল ফ্যামিলি মেম্বার’ বা একক উপভোক্তাকে এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে আরও যাচাই করার কথা ভাবা হয়েছে।