চালকলের ধোঁয়া। নিজস্ব চিত্র
শীতের দুপুরে জানলা খুলে রোদে গা-এলিয়ে বসে থাকার উপায় নেই। চালকলের ছাই উড়ে এসে ভরিয়ে দেবে খাবার-দাবার, বিছানা। তার সঙ্গে যন্ত্রের বিকট শব্দ। আওয়াজে ঘুম, পড়াশুনো উবে গিয়েছে শহরের একাংশের বাসিন্দাদের।
বর্ধমান শহরের আলমগঞ্জ, ইছালাবাদ, বাজেপ্রতাপপুর, তেলিপুকুর এলাকায় ২৭টি চালকল রয়েছে। যার মধ্যে ২১টি নিয়মিত চালু থাকে। একসময় এই চালকলগুলি ঘিরেই বসতি গড়ে উঠেছিল আশপাশে। এখন লোক বেড়েছে। চালকলের বয়স বাড়ায় যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়েছে। ধোঁয়া, ছাই, আওয়াজে মুশকিলে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ইছালাবাদের একটি চালকলের ছাই উড়ে গিয়ে পড়ে শ্রীপল্লি-অফিসার্স কলোনিতে। আর ওই চালকলের যন্ত্রের দূষণে ভোগে ২ নম্বর ইছালাবাদ ও কলোনি ইছালাবাদ। চালকলের পাশেই থাকেন সুধাংশু কর্মকার। তাঁর দাবি, ‘‘শব্দ দূষণের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’’ অনিল মজুমদার, জয়ন্ত কর্মকারদেরও দাবি, ‘‘২০০৫-০৬ সালে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলাম। কয়েক বছর দূষণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আবার কালো ধোঁয়ায় ভরছে এলাকা।’’ আলমগঞ্জ এলাকার অবস্থা আরও শোচনীয়। ওই এলাকার হারাধনপল্লির জ্যোতি সোনকারের দাবি, ‘‘সব সময় জানলা বন্ধ রাখতে হয়। নাহলে ছাই উড়ে রান্নাঘরে চলে যায়।’’ পাশের মাটিবাগ এলাকার সিদ্ধার্থ ঘোষের কথায়, ‘‘এখন মনে হয়, বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচি। শব্দ দূষণ নিয়ে প্রশাসনের ভাবা উচিত।’’ প্রত্যেকেরই দাবি, ভোর চারটের সময় চালকলের শব্দে ঘুম ভাঙে তাঁদের। তখন থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়েও চালকলের যন্ত্রের বিকট আওয়াজ চলে। বাজেপ্রতাপপুরের ব্যবসায়ী শেখ ইব্রাহিমের ক্ষোভ, ‘‘সবাই তো দেখছে। কাকে আর কী বলব?”
সমস্যার কথা মেনেছে বর্ধমান জেলা চালকল মালিক সমিতি। সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি আব্দুল মালেক বলেন, ‘‘আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শহরের বাইরে ‘ফুড পার্ক’ করার দাবি জানিয়েছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী জেলা প্রশাসনকে জায়গা দেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দশ মাস কাটতে চলল, এখনও জায়গা পেল না জেলা প্রশাসন।’’ সংগঠনের দাবি, বেশির ভাগ চালকলে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। ফলে কালো ধোঁয়া আর ছাইয়ের প্রকোপ বেশি। বর্তমান পরিকাঠামোয় ওই চালকলগুলিকে আধুনিক করা কার্যত অসম্ভব বলেও তাঁদের দাবি। ছাই ফেলার জায়গা নেই বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। মালিকদের দাবি, শহরের বাইরে ছাই ফেলার বিপুল খরচ। সে কারণে বেশির ভাগ চালকলই যত্রতত্র ছাই ফেলে দেয়। আর বর্জ্য পদার্থ মিশে দূষিত হয় বাঁকা নদী। এ ছাড়াও রাতভর যন্ত্র চলে, তার আওয়াজে বিরক্ত হন স্থানীয় মানুষজন। সংগঠনের সম্পাদক সুব্রত মণ্ডলের দাবি, ‘‘দূষণের জন্য ব্যবসা চালাতে গিয়ে সামাজিক ভাবে সমস্যা হচ্ছে।’’
জেলা ক্ষুদ্র শিল্পের জেনারেল ম্যানেজার অভিজিৎ কর বলেন, ‘‘জায়গা খোঁজা হচ্ছে। জেলাশাসকও বিষয়টি দেখছেন। চালকল মালিকদেরও জমি দেখতে বলা হয়েছে।’’ আব্দুল মালেকের দাবি, ‘‘একটি চালকলের জন্য ন্যূনতম তিন একর জমি প্রয়োজন। একলপ্তে অত জমি পাওয়া না গেলে আমরা লিখিত ভাবে জানিয়েছি, চালকলের চরিত্র বদল করে জমি বিক্রি করার সুযোগ দেওয়া হোক। তাহলে আমরা শহরের চালকলগুলি বন্ধ করে বাইরে গিয়ে নিজেরাই চালকল তৈরিতে উদ্যোগী হতে পারব।’’ দূষণ পর্ষদের আঞ্চলিক অধিকর্তা (দুর্গাপুর) বিপ্লব বৈদ্য বলেন, ‘‘দশ দিন হল দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি শুনলাম। খোঁজ নিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’’