চলছে বালি খোদাই। — ফাইল চিত্র।
বিপদ যেন ওঁত পেতে বসে থাকে। তার পরেও বিকল্পের কথা ওঁরা ভাবতে পারেন না। কারণ, ভাত জোগায় নদীর চরের বালিই।
অজয়ের পাড়ের কেতুগ্রামের রসুই, চরখি, বিল্বেশ্বর, মঙ্গলকোটের সাগিরা, খেরুয়া, বকুলিয়া থেকে দামোদরের পাড় লাগোয়া গলসি, খণ্ডঘোষ, রায়না, মাধবডিহি, জামালপুরের নানা গ্রামের অনেক বাসিন্দা নির্ভরশীল এই বালি কারবারের উপরে। দামোদর-অজয়ের জল কমতেই বালির চর জেগে ওঠে। ইজারাদারেরা বালি খাদানের ‘দখল’ নেন। কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে অজয়, দামোদরের পাড়। বালি তোলার সময়ে আইনের বিধিনিষেধ বহু সময়েই হারিয়ে যায়, এমন অভিযোগ ওঠে ভুরিভুরি। তবে জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের দাবি, অনেকগুলি বেআইনি খাদান বন্ধ করা হয়েছে। অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গত দু’মাসে প্রায় সাড়ে তিনশো বালির ট্রাককে নিয়ম ভেঙে চলাচলের অভিযোগে আটকে প্রায় পৌনে দু’কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
সে সব যেমন হয়েছে, অভিযানের পাল্টা প্রতিক্রিয়াও হয়েছে কারবারিদের তরফে। কয়েক মাস আগে কাটোয়ায় অতিরিক্ত বালি বোঝাই ট্রাক ধরতে যাওয়া পরিবহণ দফতরের গাড়িকে পাল্টা ধাওয়া করা হয়। পূর্বস্থলী পর্যন্ত ধাওয়া করে গাড়ি লক্ষ করে গুলি চালানো হয়। কোনওমতে প্রাণে বাঁচেন কর্মী-আধিকারিকেরা। প্রশাসনের কর্মীদের একাংশ থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের দাবি, কারবারিদের এমন মরিয়া আচরণের পিছনে রয়েছে বালি কারবার ঘিরে তৈরি হওয়া অর্থনীতি।
সেই অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নদী লাগোয়া ওই গ্রামবাসীর জীবন-জীবিকাও। নানা সূত্রের দাবি, একটি খাদানে যন্ত্র দিয়ে বালি কাটা হলেও ন্যূনতম ৪৭ জন শ্রমিক প্রয়োজন হয়। কোদাল-বেলচা দিয়ে বালি তুলতে হলে অন্তত ১১২ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। তাঁদের বড় অংশই স্থানীয়। খাদান ঘিরে তৈরি হয় চা, তেলেভাজার দোকান থেকে ছোটখাটো হোটেল। খাদান এলাকায় তাই কৃষিকাজের চেয়ে বালি তোলায় আগ্রহ বেশি থাকে এলাকাবাসীর একাংশের। খাদানে কাজ করা সুমন্ত দাস, পবিত্র বিশ্বাসদের দাবি, “চাষের কাজ করে দিনে ২৫০-৩০০ টাকা রোজগার করা যায়। সেখানে খাদানে কাজ করে দিনে ৮০০ টাকাপর্যন্ত মেলে।’’
গলসির শিকারপুরে বালি বোঝাই ট্রাক উল্টে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছিল কয়েক বছর আগে। জামালপুরে মুইদিপুরে একই রকম ঘটনায় এক পরিবারের তিন জন মারা যান। মঙ্গলকোট ও কেতুগ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, অজয় থেকে বালি তুলে বাঁধের উপর দিয়ে ট্রাক চলাচলে বাঁধের ক্ষতি হয়। নদীর গতিপথও ব্যাহত হয়। যন্ত্র দিয়ে, নদীগর্ভ থেকে পাম্প করে বেআইনি ভাবে বালি তোলায় নদীতে মাছ কমে যাচ্ছে বলে মৎস্যজীবীদের দাবি। এ সব কাজ করতে গিয়ে বিপদও বাড়ে। অনেকে বালির গর্তে পড়ে মারা যান।
দীর্ঘদিন বালি কারবারে যুক্ত লোকজনের দাবি, এক-একটি খাদান থেকে সরাসরি ১৭৫ জন উপকৃত হন। এ ছাড়া, খাদানের বাইরে চরের বালি কেটে স্থানীয় ভাবে বিক্রি করাও অনেকের জীবিকা। এ সবের বাইরে, ট্রাক্টর বা ট্রাক ভাড়া, বালি তোলার যন্ত্র ভাড়া দিয়ে অনেকে আয় করেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অনেকের আয়ের পথ করে দেয় বালি খাদান। সে জন্য বেআইনি কাজ করেও পার পেয়ে যান অনেক কারবারি। সে কথা মেনে নিচ্ছেন নানা রাজনৈতিক দলেরনেতারাও। (শেষ)