বালুচরী বুনতে ব্যস্ত শিল্পী।—নিজস্ব চিত্র।
বছরভর সমান যত্নে শাড়ি বুনলেও পুজো-পার্বণ বা বিয়ের মরসুম ছাড়া ব্যবসা জমে না তাঁতশিল্পীদের। এই সময়েই জন্যই নিত্যনতুন নকশা, সুতোর কাজের খোলতাই জমিয়ে রাখেন তাঁরা। কিন্তু এ বারের বন্যায় প্রস্তুতি পর্বের ফাঁক পড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা এক ধাপে আরও বেড়ে গিয়েছে তাঁদের। পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুর, সমুদ্রগড় প্রভৃতি এলাকার হাজার খানেক তাঁতশিল্পীদের দাবি, এমনিতেই পাওয়ারলুমের বাজারে মার খাচ্ছেন তাঁরা। তারপর বৃষ্টিতে তাঁত ঘরে জল ঢুকে যা পরিস্থিতি হয়েছে তাতে বোধহয় ঘুরে দাঁড়াতেই অনেক সময় লেগে যাবে। তার উপর কম দামে নানা রকমের সিল্ক, বাংলাদেশের হ্যান্ডলুম শাড়ির বাজারে জরি পাড় তাঁতের চাহিদা অনেকটাই কমে গিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও।
সাধারণত পুজোর মাস পাঁচেক আগে থেকেই দিনরাত এক করে তাঁতযন্ত্রে ঝড় তোলেন শিল্পীরা। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে বিভিন্ন নকশার বরাত দিয়ে যান। অনেক তাঁতি আবার পাইকারি বাজারে গিয়ে শাড়ি বিক্রিও করে আসেন। সমুদ্রগড়ের পাইকারি বাজারে যেমন, শিলিগুড়ি, কলকাতা, আসানসোল থেকে অনেকে এসে ট্রাকে করে মাল নিয়ে যান। এলাকার অনেক ব্যবসায়ীও পুজোর মাস দু’য়েক আগে থেকে শাড়ি পাঠাতে থাকেন নানা জায়গায়। এ বারও সেই মতোই জোরকদমে প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু জুলাই মাসেই ছন্দপতন হয়। ধারাবাহিক বৃষ্টি ও মেঘলা আবহাওয়ায় বহু তাঁতযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে। সমুদ্রগড়, বগপুর, শ্রীরামপুর, জাহান্নগর, পাটুলি-সহ বেশির ভাগ তাঁত এলাকাতেই বন্যা পরিস্থিতি দেখা যায়। ঘরদোর ফেলে তাঁতশিল্পীরা কেউ ত্রাণ শিবিরে কেউ বা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেন। এমনকী এখনও শ্রীরামপুর এলাকার এখনও বহু তাঁত ঘরে জল জমে রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা নবদ্বীপ ষ্টেশন বা আশপাশে ত্রিপলের আচ্ছাদনে দিন কাটাচ্ছেন। ত্রাণ শিবিরে থাকা এক তাঁতশিল্পী বিষ্ণু বসাক যেমন বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে বালুচরী শাড়ি তৈরি করি। প্রতিবার পুজোর আগে ভাল অর্ডারও পাওয়া যায়। এ বারও পেয়েছিলাম। কিন্তু কিছুটা কাজ এগোনোর পরেই বিপর্যয় নেমে এল।’’ তাঁর দাবি, তাঁত ঘরে জল ঢুকে তাঁতযন্ত্র এবং পুজোর কাজের জন্য কেনা সুতো, রং নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সবটা সামাল দিতে পারবেন কি না সে নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে তাঁর। আর এক তাঁত শিল্পী যমুনা দেবনাথ বলেন, ‘‘পুজোর আগে কাঁচামাল কেনার জন্য মহাজনের কাছে অগ্রিম টাকা নেওয়া হয়। পরে কাপড় দিয়ে সে টাকা শোধ করা হয়। এ বার বৃষ্টিতে ওই টাকার বেশির ভাগই সংসার খরচে চলে গিয়েছে। এখন মহাজনকে না টাকা, না শাড়ি কিছুই দিতে পারছি না।’’ উল্টে ঘর মেরামত করতে বাজারে আরও দেনা হয়ে গিয়েছে বলেও তাঁর দাবি। হস্তচালিত তাঁত দফতরও জানিয়েছে, কালনা মহকুমার প্রায় ৩০ হাজার তাঁতির ঘরে জল ঢুকে গিয়েছে। যার মধ্যে পূর্বস্থলী ১ ব্লকে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৬টি তাঁতঘর। আংশিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় তিন হাজার তাঁত ঘরের। রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্প দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথের অবশ্য আশ্বাস, ক্ষতিগ্রস্ত তাঁতিদের তালিকা তৈরি করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যাঁদের যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে তাদের তাঁতিসাথী প্রকল্পে নতুন তাঁত দেওয়া হবে বলেও তাঁর দাবি।
তবে তার মধ্যেও ঐতিহ্য মেনে সমুদ্রগড়, নসরতপুর-সহ বেশ কয়েকটি তুলনামূলক উঁচু এলাকায় তাঁত বোনা শুরু হয়েছে। যদিও চাহিদা তেমন নেই বলে তাঁতিদের আক্ষেপ। শ্রীরামপুর পঞ্চায়েতের ফরিদপুর এলাকার তাঁত শিল্পী মনোজ সাহা জানান, দিন সাতেক হল বালুচরী শাড়ি বোনা শুরু হয়েছে। তবে চাহিদা তেমন নেই। তিনি বলেন, ‘‘বছর পাঁচেক আগেও এই সময় কাপড় নেওয়ার জন্য কারখানায় লাইন পড়ে যেত।’’
ব্যবসায়ীরাও মেনে নিয়েছেন চাহিদা কমে যাওয়ার কথা। সমদ্রগড় তাঁত টাঙ্গাইল ব্যাবসায়ী সমিতির সদস্য কার্তিক ঘোষ জানান, এলাকার তাঁতিদের তৈরি মোটামুটি মানের কাপড় ১০০০ টাকার নিচে পাইকারি হচ্ছে। খোলা বাজারে দাম আর দু-তিনশো টাকা বেশি। তাঁর দাবি, কম দামে নানা ধরণের সিল্ক, পাওয়ারলুমের ভারি নকশার শাড়ি মেলায় ক্রেতারা তাঁতের শাড়ির দিকে ঝুঁকছেন না। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতাই রয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রতিবারই নতুন ধরণের শাড়ি চান ক্রেতারা। তাঁতের সঙ্গে সিল্ক বা তসরের সুতো মিশিয়ে হ্যান্ডলুমের বিভিন্ন শাড়ির চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। ফলে একই ধরণের শাড়ি বুনে বাজার হারিয়েছেন অনেক তাঁতি। পাশাপাশি কিছু বাংলাদেশি কম দামের শাড়িও বাজারের দখল নিয়েছে অনেকটাই।
(চলবে)