আসানসোলের বুধা মাঠে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: শৈলেন সরকার।
ব্যবধানটা মোটে ২৪ ঘণ্টার। সভাস্থলও সেই একই জায়গা— আসানসোল। বৃহস্পতিবারই দুর্নীতি, অনুন্নয়ন-সহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্য সরকার ও তৃণমূলকে তীব্র খোঁচা দেন প্রধানমন্ত্রী। আজ, শুক্রবার আসানসোলের বুধা মাঠ থেকে পাল্টা আক্রমণ শানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন সভায় মুখ্যমন্ত্রীকে বিজেপির অপেক্ষা রাজ্যের বিরোধী জোটকে বেশি আক্রমণ করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এ দিন আসানসোলে ঠিক যেন তার উল্টো ছবি। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য জুড়েই থাকল বিজেপি আর প্রধানমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ থাকল চোখা চোখা বাক্যবাণ।
বৃহস্পতিবার আসানসোলে পোলো মাঠের সভা থেকে দুর্নীতি প্রসঙ্গে বর্তমান রাজ্য সরকার ও তৃণমূল নেতৃত্বকে বিঁধেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, তৃণমূলকে ‘টেরর, মওত আর করাপশনের’ দল বলেও কটাক্ষ করেন মোদী। তাঁর বক্তব্যের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল সিন্ডিকেট-রাজ, কলকাতায় উড়ালপুল বিপর্যয়-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। এ দিন মমতা পাল্টা বিজেপিকে ‘ভয়ানক জালি পার্টি’ বলে কটাক্ষ করেন।
তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রী সুর চড়ানোর পর এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকেও পাল্টা প্রত্যাশা করছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা। প্রধানমন্ত্রীর কথার রেশ ধরে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী আপনি যখনই বাংলায় আসেন, খারাপ খারাপ কথা বলেন। অসম্মানজনক কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের অমর্যাদা করছেন।’’ শুধু তাই নয়, ইস্কোর আধুনিকীকরণের কৃতিত্বও বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নয় বলে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর ঘন ঘন বিদেশ সফর প্রসঙ্গেও সরব হতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। তা ছাড়া দার্জিলিং প্রসঙ্গেও তাঁর কটাক্ষ, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কোথায় দেশ জোড়া লাগাবে, তা না, বাংলা ভাগ করতে এসেছে।’’
তবে শিল্পাঞ্চলের রাজনৈতিক মহলের মতে, এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণের কেন্দ্রে বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রীর থাকার বিষয়টি মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। এই এলাকা থেকেই রাজ্যে বিজেপির একমাত্র সাংসদ— বাবুল সুপ্রিয় রয়েছেন। ২০১৪-র লোকসভা ভোটের বিচারে আসানসোল উত্তর, আসানসোল দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে শাসকদল প্রায় ৪৫ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিল বিজেপির থেকে। প্রধানমন্ত্রীকেও বৃহস্পতিবারের সভা থেকে আসানসোলকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে দেখা যায়। বাবুলকে মন্ত্রী করে শিল্পাঞ্চলকে দেওয়া ‘কথা’ রেখেছেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। এ দিন যদিও মুখ্যমন্ত্রী চড়া গ্রামে অভিযোগ করেন, গত দু’বছরে কেন্দ্রীয় সরকার এই এলাকার জন্য কিছুই করেনি।
রাজ্যে ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ার পর থেকেই সারদা কাণ্ডের তদন্ত খানিক থিতিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে তৃণমূল-বিজেপি গোপন আঁতাতের অভিযোগ তোলেন বাম-কংগ্রেস নেতৃত্ব। রাজনৈতিক মহলের মতে, এ দিন কেন্দ্রের শাসকদলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আসলে বিজেপির সঙ্গে দূরত্বের বার্তা দিতে চেয়েছেন।
তবে শহরের ভোটারদের একাংশের মতে, প্রধানমন্ত্রীর সভায় তীব্র গরমেও ভিড় হয়েছিল ভালই। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর সভায় আশানরূপ ভিড় হয়নি বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্বেরই একাংশ। শহরের এক তৃণমূল নেতা জানান, বিকেল ৪টে থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সভা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু এক ঘণ্টা আগেও তেমন ভিড় দেখা যায়নি সভাস্থলে। বিকেল ৫টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী সভাস্থলে পৌঁছনোর সময় অবশ্য মিছিল করে আসতে দেখা যায় দলীয় কর্মী, সমর্থকদের। এক তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘গতিক খারাপ বুঝে আসানসোল উত্তর কেন্দ্র থেকে লোকজন এনে সভাস্থল ভরাতে হয়েছে।’’ শেষ বেলায় বিএনআর ও আসানসোল বাজার এলাকা থেকে আসা মিছিলেই শেষমেশ সভার মুখরক্ষা হয় বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।
সভা থেকে রাজ্যের বিরোধী জোটকে খানিক চেনা সুরেই কটাক্ষ করতে শোনা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। রাজ্যে বেসরকারি অর্থ লগ্নি সংস্থার জন্মও বাম আমলে হয়েছে বলে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর বিজেপি-আক্রমণকে অবশ্য লোক দেখানো বলেই কটাক্ষ করেছেন জোট নেতৃত্ব। সিপিএমর রাজ্য কমিটির সদস্য বংশোগোপাল চৌধুরী বলেন, ‘‘এ সব লোক দেখানো বিষয়। আমরা ভালই বুঝতে পারছি দিল্লিতে মোদী ও এখানে দিদি হাত ধরাধরি করেই চলছেন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণকে পাত্তা দিতে নারাজ বিজেপি। দলের বর্ধমান জেলা সভাপতি তাপস রায় বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী যা বলার বলে গিয়েছেন। এ বার মানুষের জবাব দেওয়ার পালা। ১৯ মে বোঝা যাবে মানুষ কাদের পক্ষে থাকলেন।’’