বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কারও নতুন ক্লাসে জোটেনি নতুন বই। কাউকে আবার ফ্যান ভাত খেয়েই স্কুলে ছুটতে হয়েছে। কিন্তু অভাব যে পড়াশোনায় প্রভাব ফেলতে পারেনি, মাধ্যমিকের ফলে সেটাই বুঝিয়ে দিল ওরা।
ছেলেটির বাবা ভোলানাথ পাল মাত্র ৪ হাজার টাকা মাইনের চাকরি করেন। ভোলানাথবাবু জানান, সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হয় নিজের কাজে। ততক্ষণে অবশ্য পড়তে বসে যায় ছেলে শুভদীপ। পাঁচগাছিয়া মনহরবহাল বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনের পড়ুয়া শুভদীপ এ বারের মাধ্যমিকে ৯০ শতাংশেরও বেশি নম্বর পেয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। শুভদীপ জানায়, বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। প্রতিদিন হেঁটেই যাতায়াত করতে হয়। বাড়িতে চাল বাড়ন্ত হওয়ায় অনেক সময়েই ছেলে শুকনো মুড়ি অথবা ফ্যান ভাত খেয়েই স্কুলে গিয়েছে বলে জানান মিনুদেবী। বলতে বলতেই চোখটা ছলছল করে ওঠে তাঁর। তবে মা’কে আশ্বস্ত করেই শুভদীপ জানায়, বাড়ির অভাব পড়াশোনায় প্রভাব ফেলেনি। সবসময় স্কুলের শিক্ষকেরাও সাহায্য করেছেন বলে জানায় শুভদীপ। গৃহশিক্ষক ছিল না একটাও। তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সোমনাথ মুখোপাধ্যায় প্রায়শই নিজের বাড়িতে ডেকে তৈরি করেছেন তাঁর ছাত্রকে। ছাত্রের তবে একটাই আক্ষেপ, ‘‘অল্প কয়েকটা নম্বরের জন্য ইংরেজিতে লেটারটা হল না।’’ শুভদীপ ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় বলে জানায়। তবে উচ্চ শিক্ষার খরচ কোথা থেকে মিলবে তা নিয়ে সংশয়ে গোটা পরিবার।
শুভদীপের মতোই ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় কাঁকসার মাজুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা শুভ্রদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরিবারের সম্বল বলতে ছিল মোটে ৪ বিঘা জমি। জমির আয়েই চলে সংসার। মাধ্যমিকের ঠিক এক বছর আগে শুভ্রদেবদের সেই অল্প জমিতেই পড়ল কোপ। হার্টের অসুখ ধরা পড়ল শুভ্রদেবের বাবা দেবপ্রিয়বাবুর। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে দেড় বিঘে জমি বিক্রি করে দিতে হয় বলে জানান দেবপ্রিয়বাবু। তার উপর গেল বছর বর্ষায় ভেঙে পড়ল বাড়ির একাংশ। ঠায় মিলল পাশেই, পিসির বাড়িতে। কিন্তু এতকিছুও টলাতে পারেনি ত্রিলোকচন্দ্রপুর জরিলাল স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়া শুভ্রদেবকে। লক্ষ্যে অবিচল থেকেই এ বারের মাধ্যমিকে তার প্রাপ্তি ৮০ শতাংশেরও বেশি নম্বর। বাংলা ও বিজ্ঞানের সবকটি বিষয়েই মিলেছে লেটার। গ্রামেরই দু’জন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত সাহায্য মলেছে বলে জানায় শুভ্রদেব। তবে এ বার উচ্চশিক্ষা কী ভাবে হবে, ভেবে কুল পাচ্ছেন না বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। এমনকী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির টাকা জোগাড় করতে না পারায় বুধবার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে পারেননি বলে জানান দেবপ্রিয়বাবু।
মানকর গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক দিয়েছিল উত্তর রায়পুরের বাসিন্দা সোহিনী গোস্বামী। মাধ্যমিকে তার প্রাপ্ত নম্বর ৮৬ শতাংশেরও বেশি। ইংরেজি বাদে প্রতিটি বিষয়েই মিলেছে লেটার। সোহিনীর বাবা সুদেব গোস্বামী গ্রামেই হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা করেন। তবে আয় তেমন নেই। অর্থের অভাবে মেয়েকে একটিই মাত্র গৃহশিক্ষক দিতে পেরেছিলেন বলে জানান সুদেববাবু। মেয়ের ইচ্ছে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার। তবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার খরচ সামলাতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সুদেববাবু। তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া কুণ্ডুর আশ্বাস, ‘‘অর্থের অভাব শিক্ষার অন্তরায় হতে পারবে না।’’
বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায় দিনমজুর পরিবারের সন্তান সুমন গড়াই। লাউদোহার ইছাপুর এনসি হাইস্কুলের ছাত্র সুমনের প্রাপ্ত নম্বর ৯৩ শতাংশ। সুমনের বাবা শঙ্কর গড়াই পেশায় দিনমজুর। ভাল ফল করলেও ভবিষ্যতে ছেলের পড়ার খরচ কে জোগাবে, তা নিয়ে চিন্তায় শঙ্করবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও রকমে সংসারটা চলে। এ বার ছেলের পড়াশোনার টাকা কোথা থেকে আসবে জানি না।’’ সুমনের গলাতেও শঙ্কা, ‘‘মাঝপথে পড়া বন্ধ হয়ে যাবে না তো!’’ এই স্কুলেরই ছাত্র সতীনাথ চট্টোপাধ্যায়। মাধ্যমিকে তার নম্বর ৯১ শতাংশ। বড় হয়ে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চায় সে। সতীনাথের বাবা নির্মলবাবু বাড়ি বাড়ি পুজো করে কোনও রকমে সংসার টানেন। তাঁরও শঙ্কা, ভবিষ্যতে ছেলের পড়াশোনার খরচ কী ভাবে মিলবে। বাবার চিন্তায় মুখটা খানিক কালো হয়ে আসে সতীনাথেরও। তবে পরক্ষণেই সে বলে ওঠে, ‘‘টাকার অভাবে প়ড়া তো ছাড়ব না।’’— আপাতত এই প্রত্যয়টাই ভরসা সতীনাথদের।
নিজস্ব চিত্র।