ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া চিত্তরঞ্জনের উত্তম শর্মা। নিজস্ব চিত্র।
মঙ্গলবার দুপুরের পরে, আরও ‘অনিশ্চিত’ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন দুর্গাপুরের রাতুরিয়ার যমজ বোন রুমকি ও ঝুমকি গঙ্গোপাধ্যায়-সহ জেলার অনেক পরিবার। কারণ, বিভিন্ন সূত্রে তাঁদের পরিবারের সদস্যেরা জেনেছেন, রাজধানী কিভ থেকে প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার দূরের খারকিভ শহরে মৃত্যু হয়েছে ভারতীয় এক ছাত্রের।
এর পরেই, স্থানীয় প্রশাসন পড়ুয়াদের অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, তা জানা নেই দুই বোনের। এমনটাই জানা গিয়েছে পরিবার সূত্রে।
রাতুড়িয়ার ধীরেন ও সুনন্দা গঙ্গোপাধ্যায়ের দুই মেয়ে রুমকি-ঝুমকি। তাঁরা খারকিভ শহরের ‘খারকিভ ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি’-তে এমবিবিএস পড়তে গিয়েছেন। কলেজের হস্টেলে থাকেন। যুদ্ধ শুরুর দ্বিতীয় দিন থেকেই তাঁদের ঠাঁই হয়েছে হস্টেলের ‘বেসমেন্টে’। ফোনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না সে ভাবে। কর্মসূত্রে পোল্যান্ডে বসবাসকারী পরিচিত এক জন দীননাথ মল্লিকের মাধ্যমে মেয়েদের খবর পাচ্ছেন গঙ্গোপাধ্যায় দম্পতি।
দীননাথের দাবি, তিনি মঙ্গলবার খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সোমবার রাতে কলেজ ক্যাম্পাসের কাছাকাছি বোমা পড়েছে। রুমকি-ঝুমকিদের হাতে টাকা-পয়সা কম। এটিএম কাউন্টার সব খোলা নেই। যেগুলি খোলা আছে, সেগুলিতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি টাকা তোলা যাচ্ছে না। এ দিন রুমকি-ঝুমকিকে একটি অডিয়ো বার্তায় বলতে শোনা যায়, “দুপুরের দিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমাদের অন্যত্র নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে কোথায়, তা জানাননি কর্তৃপক্ষ।” ধীরেন বলেন, “শুনেছি, ওদের ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। এ সব ভেবে উৎকণ্ঠা ক্রমশ বাড়ছে।” সুনন্দা বলেন, “মেয়েরা জানিয়েছে, হাতে ওদের তেমন টাকাপয়সা নেই। কী ভাবে যে সমস্যা মিটবে, জানি না!”
দুশ্চিন্তা কাটেনি ‘চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস’ কারখানার কর্মী পশুপতি শর্মারও। মঙ্গলবার সকালে তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা হতাশই হয়েছেন। পশুপতি বলেন, “যুদ্ধ না থামলে, আমার ছেলে উত্তম বোধ হয় ফিরতেই পারবে না!” পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৭-র এপ্রিলে বাড়ির ছোট ছেলে উত্তম ডাক্তারি পড়ার জন্য ইউক্রেনে যান।
মঙ্গলবার বিকেল ৪টে নাগাদ ‘হোয়াটসঅ্যাপে’ উত্তমের সঙ্গে কথা হয় পশুপতির। উত্তম বলেন, “আর কিছু ক্ষণ পরে হাঙ্গেরি সীমান্তে পৌঁছনোর কথা। কিন্তু সেখান থেকে কখন দেশে ফেরার বিমান পাব জানি না!” সে সঙ্গে তিনি জানালেন, এত দিন তিনি কিভ শহরেই ‘বাঙ্কারে’ আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই শহরের ‘বোগোমোলেটস ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভাসির্টি’তে তিনি ডাক্তারি পড়েন। সেখানেই কলেজের হস্টেলে থাকেন। কাঁপা গলায় তিনি বলেন, “এমন অবস্থায় পড়তে হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি! ছিন্নভিন্ন কিভ শহরটাকে অচেনা লাগছে! প্রাণ হাতে করে সীমান্তের দিকে যাচ্ছি।”
এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা হবে। খারকিভ রেলস্টেশন থেকে বাড়িতে ফোন করেছিলেন আসানসোলের ওকে রোডের বাসিন্দা সালহিন সাজিদ। এ-পারে ‘লাউড স্পিকার’-এ কথা বলছিলেন বাবা মহম্মদ সাজিদ আখতার। সাহলিন বলেন, “সকাল ১০টা নাগাদ আমাদের কয়েক জনকে নাকোবা মেট্রো রেলের সুড়ঙ্গ থেকে বের করে, খারকিভ স্টেশনে আনা হয়েছে। শুনছি, ট্রেনে করে কোনও একটা সীমান্ত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকেই দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে।” বাবা সাজিদ বলেন, “সোমবার রাতে টেলিভিশনে খবর শুনেছি, শান্তি-প্রক্রিয়া ধাক্কা খেয়েছে। মেয়ের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা
হচ্ছিল। তবে সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জেনে, কিছুটা চিন্তামুক্ত হলাম।”
সোমবারই বাড়ি ফিরেছেন উখড়ার বাসিন্দা পর্ণশ্রী দাস, পানাগড় বাজারের জ্যোতি সিংহ। মঙ্গলবার অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) অভিজিৎ সেভলে বলেন, “এখনও পর্যন্ত এই জেলার ১৩ জন ইউক্রেনে আটকে আছেন বলে জেনেছি। তাঁদের দেশে ফেরাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে।” সেভলে জানান, নবান্নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বিদেশ সচিবের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। যাঁরা আটকে রয়েছেন তাঁদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি, বিশেষ বিমানে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ চলছে। দিল্লি পৌঁছনোর পরে, তাঁদের সেখান থেকে বিমানে করে অন্ডাল বা কলকাতায় ফেরানোর সব ব্যবস্থা তৈরি রয়েছে।