বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন ফুলমণি। নিজস্ব চিত্র।
বয়স মেরেকেটে ১৮ কি ১৯। ফুলমণি কিস্কু। পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রামের কাছে যাদবগঞ্জ। সেখানকার ঝাড়গাড়িয়া আদিবাসী পল্লীর বাসিন্দা। কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁকে জমিতে খেতমজুরের কাজও করতে হয়। সংসারের এই অভাবকে সঙ্গী করেই স্বপ্ন দেখছেন ফুলমণি। সেই স্বপ্ন আবর্তিত অজ পাড়াগাঁয়ের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ঘিরে। যারা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। যাদের বাড়ির লোকের সামর্থ নেই পড়াশোনায় সাহায্য করার। তাদের নিয়েই রোজ সকালে ফুলমণির বাড়ির ছোট্ট উঠোনে বসে বিনে পয়সার পাঠশালা।
যাদবগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকাতে বেড়ে ওঠা ফুলমণির। ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছিলেন। মা মাকালু কিস্কু তাঁকে এবং তাঁর দুই দাদাকে কষ্ট করে মানুষ করেছেন। সংসারে অভাব নিত্যদিনের। তাঁর দুই দাদা এবং মা সকলেই খেতমজুরির কাজ করেন। ফুলমণিকেও মাঝেমধ্যে যেতে হয় সেই কাজে। এই অভাবের সঙ্গে লড়াই করেই ফুলমণি এখন গুসকরা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ভবিষ্যতে নার্স হয়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্ন দেখেন। এর মধ্যেই তাঁর নজরে আসে গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা অনেক বেশি সংখ্যায় স্কুলে যাচ্ছে। তাদের অধিকাংশই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। তাই স্কুলের বাইরে তাদের পড়াশোনায় সাহায্য করার মতো কেউ নেই। টিউশন দেওয়ার সামর্থ্যও নেই তাঁদের পরিবারের। তাই তাঁদের জন্য এগিয়ে গিয়েছেন ফুলমণি নিজেই। সেই কচিকাঁচাদের ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে ফুলমণির স্বপ্ন।
ফুলমণি এদের জন্য খুলে বসেছেন বিনে পয়সার পাঠশালা। নিজের বাড়ির ছোট্ট বারান্দায় প্রতিদিন ভোরে তিনি পাঠশালা সাজান। ৬টা বাজতে না বাজতেই হইহই করে চলে আসে কচিকাঁচার দল। সংখ্যায় তারা প্রায় জনা ৩০। তাদের কলকাকলিতে গমগম করে ওঠে ফুলমণিদের ছোট্ট উঠোন। এই বাচ্চাদের পড়ানো, তাদের খুনসুটি সামলানো, সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখার ঝক্কি কম নয়। কিন্তু এই কাজে খুশি ফুলমণি। আসলে সকলকে জড়িয়ে বাঁচার আনন্দই যে আলাদা, তা এই বয়সেই বুঝেছে যাদবগঞ্জের ওই আদিবাসী কিশোরী। যাদবগঞ্জের মানুষও তাঁকে খুব ভালবাসে। গর্বও করে।
ফুলমণির বাড়ির বারান্দায় পাঠশালা। নিজস্ব চিত্র।
ফুলমণি অবশ্য অতশত বোঝেন না। তবে তাঁর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন মা মাকালু কিস্কু। তিনি বলেছেন, ‘‘জানি না আর কতদিন মেয়েকে কলেজে পড়াতে পারব। সংসারের অভাব অনটন সামলে মেয়ে কলেজ যায়।’’ যদিও এ সব নিয়ে ভাবেন না ফুলমণি। বাড়ির উঠোনের এই পাঠাশালাকে নিয়ে নিজের স্বপ্নে মশগুল তিনি।