Society

আশ্রয়ের আড়ালে লড়াই

রাধা হোক বা মাধবী, ছেলেমেয়েদের ছোট থেকেই শিখিয়েছেন, বাড়িতে অভাব থাকুক। কিন্তু ভালবাসার শিকড়গুলো যাতে মাটিকে আঁকড়ে থাকে।

Advertisement

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:১৯
Share:

অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র।

অজয়ের ভরা গাঙে তর্পণ সারা। দেবী প্রতিমা চলে এসেছে পাড়ায়। গ্রামে প্যান্ডেল বাঁধা শেষ। আশপাশে ভিজে-হাওয়ায় ডাগর কাশফুলের দল যৌবনের ছন্দে উচ্ছল। সেই ছন্দের মধ্যেই মেঘ হয়ে ছুঁয়ে যায় আমাদের মায়েদের স্মৃতি-সত্তা-বর্তমানের আখর। সে আখরে হয়তো বা দেবী দুর্গা বা গণেশ-জননীর মহাকালের মহাকাব্য রচিত হয়। তার মধ্যেই আমরা যেন আশ্রয় পেতে চেয়েছি। কিন্তু ভুলে থাকছি বাস্তবের গণেশ জননীদের ঘরে-বাইরের নিয়ত লড়াইয়ের সুকঠিন গদ্য।

Advertisement

কেতুগ্রামের নিরোল পশ্চিমপাড়া। কয়েক বছর আগেও পুজো এলে যেন এক চিলতে মাটির বাড়িটায় একটু বেশি আলো পড়ত। নরম আলোয় মা দেখতেন ছোট ছেলেটার আনা শাড়ির রং। নতুন জামা গায়ে দিয়ে ঘুরতেন বাবা। সেই অসম থেকে আনা। দু’বেলা একটু ভাল খাওয়াদাওয়া। দিনগুলির গায়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে যেন শাড়ির খুঁটে চোখের জল মুছছিলেন মাধবী মণ্ডল।

“ছেলেটা পড়াশোনায় ভাল ছিল। পড়াতে পারিনি। বাড়িতে এত অভাব। সেই ১৭ বছরে বেরিয়ে গেল, অসমে, হোটেলে কাজ করতে।”

Advertisement

ছেলে পার্থসারথি সে বারও ‘ফিরেছিল’। অসময়ে, করোনা-কালে। ধার করা সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে প্রায় ১,১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফিরেছিলেন পার্থসারথি। কিন্তু ফিরব বললেই যে ফেরা হয় না। তাই গ্রামে ফিরেও এক দিকে অভাব, অন্য দিকে কাজ না পাওয়ার চিন্তায় স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেন পার্থসারথি। মোটে বছর ২৫-এ!

আশাপূর্ণা দেবী লিখেছিলেন, ‘দুর্গাপুজো বাঙালিচিত্তের সত্তার গভীরে লালিত একটি সুষমাময় ভালবাসা।’ এখনও পুজো আসে। মাধবীর বড় ছেলে, স্বামী সবাই ভিন্-রাজ্যে কাজ করেন। মাধবী আর বড় একটা গ্রামে থাকেন না। চলে যান বড় ছেলের কাছে হায়দরাবাদে বা কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে। গ্রামের ভিটেটায় যে এখন খুব অন্ধকার। কিন্তু আবছায়াতেও উজ্জ্বল থাকে পার্থের মুখটা। ভালবাসার গ্রন্থিটাই যে ছিঁড়ে গিয়েছে। তবু, মনের ঘরে প্রতিদিন লড়ছেন মাধবী...। তাই বোধহয় চাইছেন, বাড়ির ছেলেগুলো বাড়ির কাছেই কাজ পাক। সন্ধ্যা নামলে, চা-মুড়ির সঙ্গতে মিলিয়ে নেওয়া যাবে চুঁইয়ে পড়া প্রতিটা দিনের গল্প।

*****

ভালবাসার এক অন্য আখ্যান লেখা আছে কলকাতার ৭২, হিন্দুস্থান পার্কে, ‘ভালো-বাসা’ বাড়িতে। সেখানকার দোছাতির (‌মেজ়েনাইন ফ্লোর) ঘরে বসে এক বার ওই বাড়ির ‘খুকু’, আমাদের নবনীতা দেবসেন বলেছিলেন, সম্ভবত লিখেওছিলেন— ‘দুর্গাপুজোর একটাই থিম। মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, অশুভদলনী; তাঁর বাপের বাড়িতে আসছেন।’

রানিগঞ্জের সিহারসোল বাস্কেটপাড়ার রাধা, রাধা বাউড়িকে দেখতে-দেখতে কথাগুলো যেন খুব কানে ভাসে। বিশেষত ওই ‘অশুভদলনী’ শব্দটা। রাধার প্রায়ই মনে পড়ে ‘অশুভ’ দিনটা: স্বামী প্রকাশ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন যেদিন। ছেলে বিবেক, মেয়ে নিবেদিতাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়লেন। কিন্তু তবুও যে গণেশ জননীরা ছেলেমেয়েদের গায়ে বিছিয়ে রাখেন পৃথিবীর সবটুকু শুভর চাদর। তাই, টালির ছাউনি দেওয়া এক কামরার বাড়িটা থেকে কাজের সন্ধানে বেরোলেন রাধা। সকালবেলা বেরিয়ে পড়েন। দু’বাড়িতে পরিচারিকার কাজ। দুপুরে ফিরে বাড়িতে শাশুড়ি, ননদের সঙ্গে বাড়ির কাজকর্ম। জানালেন, কাজে যাওয়া-আসার পথে এ বারেও দুগ্গা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করবেন, ছেলেমেয়ে যাতে ‘বড়’ হয়ে পড়াশোনা করে একটা চাকরি পায়।

ছেলেমেয়ের বড় হওয়ার প্রস্তুতিতে শূন্যতা নামতে দেন না রাধা। তাই প্রকাশ থাকাকালীন যেমন নতুন জামাকাপড় কেনা হত, এখনও তা-ই হয়। ছেলেমেয়ের জন্য। নিজের জন্য বাজারে যাওয়া তেমন হয় না অনেক দিন।

মনে পড়তে পারে বনফুলের ‘গণেশ জননী’র নিঃসন্তান গিন্নিকে। সাধারণ গেরস্ত পরিবার। পাকেচক্রে গণেশ নামে একটি হাতি পুষেছেন গিন্নি। অজ্ঞাত অভিমানে খাওয়া বন্ধ করেছে গণেশ। গিন্নি বার্লি আর কমলালেবুর খোসা সাজিয়ে গণেশকে খাওয়ানোর জন্য কাকুতিমিনতি করছে। ডাকা হয়েছে গল্পের কথক পশু চিকিৎসককে। কিন্তু সন্তানসম প্রাণীটির প্রতি গিন্নির বাৎসল্য দেখে ‘ফি’ নেয়নি চিকিৎসক। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে সে শুনল, বাড়ির কর্তা পোদ্দারকে বলছে, ‘গয়নাগুলো তুমি ফেরত দিয়ে দাও।’ গণেশের চিকিৎসার ‘ফি’ জোগাতে গিন্নি গয়না বন্ধক রেখেছিল! আসলে রাধা বা গণেশ জননীরা এমনই। ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে ওঁরা নিজেদের সখ-আহ্লাদ ভুলে থাকেন নিয়ত।

*****

রাধা হোক বা মাধবী, ছেলেমেয়েদের ছোট থেকেই শিখিয়েছেন, বাড়িতে অভাব থাকুক। কিন্তু ভালবাসার শিকড়গুলো যাতে মাটিকে আঁকড়ে থাকে। তাই, পার্থসারথিরা যেমন বাড়ির জন্য নতুন জামাকাপড় আনত, আনে; তেমনই বিবেক বা নিবেদিতারা স্কুল যাওয়ার সময়ে তৈরি হতে হতে একে-অপরকে সাহায্য করে।

এই মূল্যবোধের শিক্ষাটি ধরা আছে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’-এও। শিব ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ফিরেছেন। কার্তিক ও গণেশ ছুটে এসেছেন। খাবারের ভাগ নিয়ে মারামারি। জিতছেন গণেশই। অগত্যা মা দুর্গার হস্তক্ষেপে কার্তিককেও খাবারের ভাগ দিতে শিখছেন গণেশ। ‘সুভাষিতরত্নভান্ডাগার’-এর একটি শ্লোকেও ভাইদের ঝগড়া থামাতে দেখা যায় দুর্গাকে।

আসলে জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের যাবতীয় খিদে বা চাহিদা পূরণের নিশ্চিন্ত ও নিশ্চিত আশ্রয় হল মায়ের আঁচল। ‘সূক্তিমুক্তাবলী’র একটি শ্লোকে শিশু কার্তিককে গিরিজার স্তন্যদানের এক শাশ্বত-রূপ তাই আমাদের মুগ্ধ করে যেন— ‘...দুগ্ধপানবিধুরাণি হরন্তু’। শিবায়নেও আমরা শুনি, ‘কার্তিক গণেশ ডাকে অন্ন আন মা।’ ছেলেমেয়েদের এমন পাশে থাকার রূপটিই যেন কল্পনায় অন্য ভাবে ধরা দেয় ‘নবপত্রিকা’য়। মণ্ডপে যে লাল পাড় সাদা শাড়ির ঘোমটা দেওয়া কলাগাছটিকে গণেশের পাশে দেখি, তা-ও যে স্বয়ং মা দুর্গা, গণেশ-জননী।

‘গণেশের মা’ সম্বোধনে হয়তো বা নারীর মাতৃরূপেরই বন্দনা। সে বন্দনা করেন স্বয়ং মহাদেবও। শাক্তগীতিতে দেখা যায়, নবমী নিশির অবসান ঘটেছে। বিদায় আসন্ন। স্বামী মহাদেব ডাকছেন, ‘বিছায়ে বাঘের ছাল, দ্বারে বোসে মহাকাল/ বেরোও গণেশ-মাতা, ডাকে বার বার।।’ (রামপ্রসাদ সেন)

*****

এই মাতৃরূপকেই আমরা আমাদের সাহিত্যে, ছবিতে বার বার আঁকতে চেয়েছি নানা ব্যঞ্জনায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গণেশ জননী’-র গণেশটি যেন আমাদের বাড়ির পরিচিত শিশুপুত্র, পার্বতীও রক্তমাংসের মা। আবার তাঁর পরিচিত শৈলীতেই যামিনী রায় আঁকছেন গণেশ ক্রোড়ে থাকা মাতৃরূপ। বিকাশ ভট্টাচার্যের ‘দুর্গা’ আবার অন্য রূপে ধরা পড়ে। সে নাগরিক নারী, জীবন-সংগ্রামে ধ্বস্ত সমাজকে দেখছে ঘাড় ঘুরিয়ে।

গণেশ-জননীদের এই দেখার স্বাধীনতাটাই দিতে চেয়েছে দুর্গা পুজো। সাক্ষ্য দেন ঠাকুরবাড়ির মেয়ে সৌদামিনী দেবী। জানাচ্ছেন, বিজয়ার দিনে প্রতিমার সঙ্গে বাড়ির ছেলেরা চলেছেন। মেয়েরা সেই দিন তেতলার ছাদে উঠে প্রতিমা বিসর্জন দেখতেন। বছরের মধ্যে ওই একটি দিনই বাড়ির মেয়েরা তেতলার ছাদে উঠতে পারতেন। সৌদামিনীর অনুভবে তা, ‘স্বাধীনতা পাইতাম’।

বস্তুত, এক দিকে, আশ্রয় দিতে দিতে ক্লান্তি, অন্য দিকে নিজের স্বাধীনতার লড়াই, গণেশ-জননীদের মনের কথার খবর আমরা রাখি কি? প্রশ্নটা রেখেই বলতে ইচ্ছা করে, আপনি, আপনারা, গণেশ-জননীরা আসলে প্রত্যেকেই এই উৎসবের আবহেও চূড়ান্ত রূপে ‘সনাতনী একা...’!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement