কালনার মুকশিমপাড়া হালদার বাড়ির প্রতিমা। বন্দুক ঠিক আছে কি না দেখা নেওয়া (ডান দিকে)। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল ।
মণ্ডপের আশপাশ থেকে ছোড়া হয় এক রাউন্ড গুলি। পূর্বস্থলী ২ ব্লকের মুকশিমপাড়ার হালদারবাড়ি থেকে গুলির শব্দ ভেসে এলে এলাকার মানুষ জেনে যান, অষ্টমীর সন্ধিপুজো শুরু হল। সাত পুরুষের পারিবারিক এই পুজোয় প্রাচীন রেওয়াজ ধরে রাখতে যত্ন করে সদস্যেরা সারা বছর রেখে দেন কাঠের লম্বা বন্দুক। সন্ধিপুজোর আগে শূন্যে গুলি ছোড়ার জন্য চলে বন্দুকের পরিচর্যা।
এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায় এই পরিবারের পুজোর ইতিহাস। প্রাচীন এই পুজো শুরু করেন অনন্তরাম বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পরের পুরুষ হরিবল্লভ জমিদারি পান। তার জেরে পরিবারের পদবি বদলে হয় হালদার। এর পরে একে একে রামকুমার হালদার, নীলকমল হালদার, কেশবচন্দ্র হালদার, নীলকান্ত হালদার, অমিয়কুমার হালদারেরা সামলেছেন পুজোর দায়িত্ব। এ বার পুজোর দায়িত্ব রয়েছে অদিতকুমার হালদারের কাঁধে।
বাড়ি, মন্দির, পুকুর-সহ ১৫ বিঘার বেশি সম্পত্তি হালদার পরিবারের। জমিদারি বিলুপ্ত হলেও এখনও উঁচু পাঁচিল এবং সাবেক ধাঁচের পুজো মণ্ডপ রয়ে গিয়েছে। তবে লাল ইটের দেওয়ালে নোনা ধরেছে। বহু কারুকাজ নষ্ট হয়েছে মণ্ডপের কংক্রিটের বিমে। জমিদার বাড়ির বহু জায়গায় মাথা তুলেছে বন-জঙ্গল। অদিত বলেন, ‘‘দাদাদের মুখে শুনেছি, আমাদের বাড়িতে হাতি থাকত। জেঠামশাই লখনউয়ে রেলে কর্মরত ছিলেন। পুজোর সময়ে বাড়ি এলে বাবা তাঁকে আনতে পাটুলি স্টেশনে হাতি পাঠাতেন। এ ছাড়া, কয়েকটি ঘোড়াও ছিল। হাতি-ঘোড়া থাকার জায়গা এখন ভগ্নাবশেষ।’’
পরিবারের সদস্য সংখ্যা কম নয়। দেশ-বিদেশে রয়েছেন অনেকে। পুজোর কিছু দিন আগে থেকে তাঁরা আসতে শুরু করেন। সদস্যদের দাবি, পুজোয় বেশির ভাগ রীতি এখনও চালু আছে। চতুর্থীর দিন প্রতিমায় পড়ে রঙের পোঁচ। নিয়ম মেনে সন্ধিপুজোর শুরুতেই ছোড়া হয় বন্দুকের গুলি। আশপাশের নানা পুজোয় তার পরে সন্ধিপুজো শুরু হয়। অষ্টমীর সকালে হয় কুমারীপুজো। ব্যবস্থা থাকে বাল্য ভোগের। পুজোতে দেবীকে নিবেদন করা হয় ১০৮ পদ্ম। ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত দেওয়া হয় নিরামিষ ভোগ। তাতে কচুর শাক, খিচুড়ি, পায়েস, পনির-সহ নানা পদ থাকে।
অদিত জানান, পুজোর দিনগুলিতে পরিবারের সদস্যেরা এক হন। এক সময়ে পুজোয় এলাকার হাজার হাজার মানুষের পাত পড়ত বাড়িতে। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে শ’দুয়েকে। পরিবারের সদস্য মহাদেব হালদার বলেন, ‘‘গ্রামে প্রায় ২৫ জন প্রতিমা কাঁধে নিয়ে দশমীর দিন গ্রাম প্রদক্ষীণ করেন। পরিবারের পুকুরে বিসর্জন পর্ব হয়। বিসর্জনের রাতে সিঁদুর খেলা হয়।’’ সারা বছর ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ি থেকে কোনও কোলাহল শোনা যায় না। শুধু দুর্গাপুজোর দিনগুলি এলাকার মানুষকে পুরনো অনেক স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়।