Artisan

পুঁজি শ্রম, বহু মেয়েকে স্বাবলম্বী করছেন মঞ্জু

গ্রামের মেয়েদের মধ্যে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহ তৈরি করে প্রতিমার মালা ও চাঁদমালা তৈরির কাজ শেখান মঞ্জুদেবী।বর্তমানে মালা তৈরির সঙ্গে যুক্ত কুড়ি জন। আর তিনশো জন চাঁদমালা তৈরি করেন। এঁদের বেশির ভাগই মহিলা।

Advertisement

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

কালনা শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৫৯
Share:

মঞ্জু পাল। নিজস্ব চিত্র।

দু’দণ্ড কথা বলার ফুরসত নেই তাঁর। সকাল ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত চরকিপাক ঘুরছেন বাড়ির একতলা থেকে দোতলা। কখনও চাঁদমালা তৈরি করছেন, কখনও গোছাচ্ছেন, কখনও আবার বরাতের জন্য বাক্সবন্দি করছেন সে সব। পূর্ব বর্ধমান তো বটেই, নদিয়া, হুগলির বহু দোকানে চাঁদমালা পৌঁছে দেন তিনি। নিজের সঙ্গে আরও কয়েকশো মহিলাকে উপার্জনের রাস্তা দেখাচ্ছেন কালনা শহরের ৬২ বছরের মঞ্জু পাল।

Advertisement

বাংলাদেশের রাজশাহীর কামারখালি এলাকা থেকে স্বামী গোবিন্দ পালকে নিয়ে ১৯৭৪ সাল নাগাদ কালনা শহরে এসেছিলেন মঞ্জুদেবী। ওঠেন ভাড়াবাড়িতে। পেশায় প্রতিমা শিল্পী গোবিন্দবাবু মাসে আট টাকা ভাড়া জোগাড় করতেই হিমসিম খেতেন। তখন থেকেই অভাবের সংসারে স্বামীর ভরসা হয়ে দাঁড়ান মঞ্জু। উপার্জনের জন্য বাড়ির কাছাকাছি জলশয় থেকে স্বামীর সঙ্গে ঘুরেই শোলা সংগ্রহ করতেন তিনি। কিশোরী অবস্থায় শেখা কাজ মনে করে সে শোলা দিয়ে রঙিন ফুল তৈরি করে ২৫ পয়সা দরে রাস্তায় বসে বিক্রি করতেন। শোলার কাজে আর একটু হাত পাকিয়ে টোপর তৈরি শুরু করেন এর পরে। এলাকার দশকর্মার দোকানে ঘুরে বিক্রি তা করে আরও কিছু টাকা আনেন ঘরে। বাড়ে আত্মবিশ্বাস। এ বার নিজের হাতে প্রতিমার সাজ তৈরি করতে শুরু করেন মঞ্জু। কাজ দেখে সাজের বরাত আসতে শুরু করে অসম, বিহারের মত রাজ্য থেকেও। তারপরে শুরু করেন চাঁদমালা তৈরি।

মঞ্জুদেবী বলেন, ‘‘অভাবের মধ্যেও আমি স্বপ্ন দেখতাম কিছু একটা করার। বছর পঁচিশ আগে বাড়ি থেকে একটা মেয়ের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে কিছু করা কঠিন ছিল। তবে হার মানিনি।’’ বড় ছেলে সুব্রতর ১৬ বছর বয়স হতেই তাকে সাইকেলে বসিয়ে আশপাশের ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে যত গ্রাম রয়েছে সেখানে ঘুরতে শুরু করেন তিনি। গ্রামের মেয়েদের মধ্যে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহ তৈরি করে প্রতিমার মালা ও চাঁদমালা তৈরির কাজ শেখান। তিনি জানান, প্রতিমার গলার মালা দিয়ে শুরু করেছিলাম। বলতে নেই, আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একটা সময়ে তিন জেলার চাঁদমালার চাহিদা একা হাতে মেটাতে পারতেন না তিনি। মঞ্জু বলেন, ‘‘বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছিলাম, সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে গেলে টাকার প্রয়োজন রয়েছে। বাড়ির কাজের ফাঁকেই প্রতিমার মালা, চাঁদমালা তৈরি করা সম্ভব। অনেকেই আমার কাছে শিখে কাজ শুরু করেন।’’

Advertisement

মঞ্জুদেবীর কাছে কাজ শিখেছেন পূর্ণিমা দাস, মণি দাসেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘সংসারের কাজ সামলে যা সময় পাই, তাতে চাঁদমালা তৈরি করি। তাতেও মাসে দু-আড়াই হাজার টাকা রোজগার হয়। উনি না থাকলে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম না।’’

সুব্রত জানান, বর্তমানে মালা তৈরির সঙ্গে যুক্ত কুড়ি জন। আর তিনশো জন চাঁদমালা তৈরি করেন। এঁদের বেশির ভাগই মহিলা। নাটাগড়, ধাত্রীগ্রাম, মির্জাবাটী, কুলেপাড়ার মতো গ্রামগুলিতে বাড়ি-বাড়ি কাঁচামাল কাগজ, সুতো, পাইপ, চুমকি, রাংতা, আর্ট পেপার, জরি পৌঁছে দেন তাঁরা। মজুরি বাবদ টাকাও পৌঁছে দেন বাড়িতেই। সংসারের কাজের ফাঁকেই মালা এবং চাঁদামালা তৈরি করে এক-এক জন মাসে প্রায় হাজার দু’য়েক টাকা রোজগার করেন, দাবি তাঁদের। মঞ্জুর দাবি, বছরভর কয়েক লক্ষ মালা ও চাঁদমালা তৈরি করেন তাঁরা। যা বিক্রি হয় বিশ্বকর্মা পুজো থেকে কালীপুজো পর্যন্ত।

ওই বৃদ্ধার কঠোর পরিশ্রমে বদলেছে পরিবারের ছবি। ভাড়া ঘর থেকে চার কাঠা জমির উপরে তৈরি হয়েছে বাড়ি। মঞ্জুদেবীর দুই পুত্রবধূ মৌসুমি পাল এবং মামনি পাল বলেন, ‘‘মা আমাদের শিখিয়েছেন হাতের কাজ। এই বয়সেও উনি হাড়ভাড়া পরিশ্রম করেন। ওঁকে দেখে আমরাও বড় কিছু করার কথা ভাবতে শিখেছি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement