প্রতীকী ছবি।
করোনার দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে পরপর তিন দিন জেলায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা নেমে এসেছিল শূন্যে। তা কিছুটা অবাক যেমন করেছিল, খানিক স্বস্তিও দিয়েছিল জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের। কিন্তু সেই স্বস্তি স্থায়ী হয়নি, বরং ক্রমশ উদ্বেগ বাড়িয়েছে মৃত্যুর হার। জেলায় করোনায় মৃত্যুর হার কেন কমানো যাচ্ছে না, সে জন্য জেলা স্তরে কমিটি গড়া হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। দৈনিক যে সব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে ওই কমিটি।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, এখন দৈনিক করোনায় মৃত্যুর গড় পাঁচে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যে কড়াকড়ি জারি হওয়ার আগে পরপর দু’দিন করোনায় ১০ ও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তখনও মৃত্যুর হার এক শতাংশের থেকে অনেকটা দূরে ছিল। বিধিনিষেধ চালু হওয়ার আগের সপ্তাহে (১০ থেকে ১৬ মে) মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছিল ০.৮৯ শতাংশে। তার পরের সপ্তাহে ওই হার দাঁড়ায় ০.৯ শতাংশে। কিন্তু ২৪ মে থেকে রবিবার পর্যন্ত সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৯৮ শতাংশে। চলতি সপ্তাহে জেলায় ৩৮ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যায়। চিকিৎসকদের দাবি, মৃত্যুর হারে পরিবর্তন হচ্ছে। জেলার জনসংখ্যার নিরিখে আক্রান্তের এক শতাংশ মৃত্যুও ভয়ঙ্কর।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রূপালী দাসঠাকুর বলেন, ‘‘অবহেলার কোনও জায়গা নেই। রোগীকে নিজের ভাল বুঝতে হবে। জ্বর-সর্দি হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। করোনার পরীক্ষা করাতে হবে। দেরি হলে যে বিপদ আসন্ন, সেটা বুঝতে হবে।’’ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দাবি, মৃত্যুহারের মতো আক্রান্তের হারও গুরুত্বপূর্ণ। আক্রান্তের হার কমাতে না পারলে প্রাণহানি কমানো যাবে না।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের দাবি, মৃত্যুর হার কমাতে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বিধি মেনে চিকিৎসা করা হচ্ছে কি না দেখার জন্য ‘প্রোটোকল মনিটরিং টিম’ বা পিএমটি গঠন হয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে কোনও খামতি বা ব্যবস্থাপনায় ফাঁক দেখলে কী করণীয়, তার পরামর্শ দেবে। যে সব হাসপাতালে মৃত্যুর হার বেশি সেখানে মেডিসিন ও বক্ষঃরোগের এক জন করে শিক্ষক-চিকিৎসকের দল গিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, করোনায় বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে রাতের দিকে। জেলার বৈঠকেও বিষয়টি উঠেছে। পরিষেবায় ঘাটতি থাকছে কি না, সে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনেক সময়ে রোগীর অক্সিজেন-মাস্ক খুলে গেলে তা লাগানোর জন্য কেউ থাকছেন না, বর্ধমান মেডিক্যালে আক্রান্তের পরিজনেরা অক্সিজেন-মাস্ক লাগাতে বাধ্য হচ্ছেন— এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাতের চিকিৎসায় খামতি এড়াতে ‘নাইট রাউন্ড’-এর উপরে জোর দিতে বলা হয়েছে। সেখানে প্রতিটি রোগীর তথ্য পূরণ করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে হাসপাতাল সুপারের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, দৈনিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে ‘ডেথ রিভিউ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে জেলায়। মৃত্যুর ক্ষেত্রে কোনও ফাঁক থাকছে কি না, রোগীর বয়স পঞ্চাশের নীচে কি না, ‘কো-মর্বিডিটি’ নেই এমন রোগীর মৃত্যু হলে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ‘পিএমটি’-র জেলা আহ্বায়ক তথা চিকিৎসক সমরেন্দ্র বসু বলেন, ‘‘অক্সিজেনের মাত্রা ৯০-৯২ হওয়ার পরেও অনেকে ভাবছেন বাড়িতেই ঠিক হয়ে যাবেন। এটা ঠিক নয়। তাঁরা হাসপাতালে যখন আসছেন, তখন আর কিছু করার থাকছে না। তাই পূর্ব বর্ধমানে সংক্রমণের হার কমলেও, মৃত্যুর হার কমছে না।’’
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, রাজ্যে কড়া বিধিনিষেধের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বর্ধমানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪,১৮৫ জন। সুস্থতার হার ছিল ৮৩.৭৭%। চলতি সপ্তাহে (২৪-৩০ মে) করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২,২৩৪ জন। সুস্থতার হার প্রায় ৯১ শতাংশ। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ) প্রণব রায় বলেন, ‘‘অনেক খারাপ অবস্থার রোগী ভর্তি ছিলেন। সে জন্য মৃত্যুর হার এখনও বেশি রয়েছে। আশা করছি, সপ্তাহখানেকের মধ্যে মৃত্যুর হারও নিয়ন্ত্রণে আসবে।’’