প্রতীকী ছবি।
রাজ্যে ‘এগিয়ে থাকা’ জেলা বলেই পরিচিত পূর্ব বর্ধমান। অথচ, সেখানে নাবালিকা বিয়ে বাড়ছে বলে ধরা পড়েছে কেন্দ্রীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য পরিষেবা মন্ত্রকের সাম্প্রতিক সমীক্ষায়। জেলা প্রশাসনও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’র মতো প্রকল্প থাকার পরেও কেন এ রকম তথ্য উঠে আসছে, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক প্রিয়াঙ্কা সিংলা। একই সঙ্গে কোথায় খামতি থাকছে, নাবালিকা বিয়ে আটকাতে কী-কী করা উচিত, সে নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্র ও ইউনিসেফ যৌথ ভাবে একটি সমীক্ষা করে। সম্প্রতি তা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য পরিষেবা মন্ত্রক। তাতে দেখা যাচ্ছে, এই জেলায় ২০ থেকে ২৪ বছরের বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৫০.৪ শতাংশের বিয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই হয়েছে। ২০১৬ সালের সমীক্ষায় সেটাই ছিল ৪২.৯ শতাংশ। আবার ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে মা হয়ে গিয়েছেন ২১.৯ শতাংশ মহিলা। পাঁচ বছর আগের সমীক্ষায় যা ছিল ১৪.৪ শতাংশ। অর্থাৎ, জেলায় নাবালিকা বিয়ে বেড়েছে সাড়ে সাত শতাংশ আর কম বয়সে মা হওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে সাড়ে সাত শতাংশ।
সম্প্রতি ইউনিসেফের একটি সভায় রাজ্যের শিশু ও নারীকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা জানান, রাজ্যের সব তথ্য রিপোর্ট হয় না। রাজ্য সরকার নাবালিকা বিয়ে রোধে কাজ করে যাচ্ছে। জেলাশাসকেরও দাবি, ‘‘গত বারের সমীক্ষার সময় দুই বর্ধমান এক ছিল। শহরাঞ্চলের হিসেব তার মধ্যে ছিল। এ বার শুধুই গ্রামীণ এলাকার তথ্য উঠে এসেছে। সে জন্যই সম্ভবত নাবালিকার বিয়ে বেশি দেখাচ্ছে।’’ নাবালিকা বিয়ে রোধে আরও নিবিড় ভাবে কাজ করায় গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং পঞ্চায়েত স্তরে নাবালিকা বিয়ে রোধে একটা কমিটি গঠন করার কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যে একটি বিশেষ ‘সেল’ গঠন করেছে। যার সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের আধিকারিক পূর্বিতা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘কী-কী করা উচিত, তা নিয়ে জেলাশাসকের উপস্থিতিতে আমরা একটা বৈঠক করেছি। একাধিক পদক্ষেপ করার কথা ভাবা হয়েছে।’’
জেলা প্রশাসনের দাবি, করোনার সময়ে নাবালিকা বিয়ের প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছিল। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের অগস্ট পর্যন্ত ৩৩২টি নাবালিকা বিয়ের খবর এসেছিল প্রশাসনের কাছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ৮০টির মতো বিয়ের খবর মিলেছে। জেলা শিশুসুরক্ষা আধিকারিক সুদেষ্ণা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সব খবরই যে ঠিক, তা নয়। শেষ কয়েক মাসে নাবালিকা বিয়ের যা খবর এসেছে, তার মধ্যে ২৮টির মতো ঘটনা সরাসরি বিয়ে সম্পর্কিত বলে জানতে পেরেছি।’’ জেলা সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রে জানা যায়, পুলিশের হিসেব অনুযায়ী, শিশু নিখোঁজের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৮ সালে জেলায় শিশু নিখোঁজ ছিল ২৮১ জন। দু’বছরের মধ্যে সেটাই দাঁড়ায় ৪৫১। যার মধ্যে বেশির ভাগই কিশোরী। তবে ৮০ শতাংশকে শিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ তাদের বাবা-মায়ের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে।
চাইল্ডলাইনের বর্ধমানের কর্ণধার অভিজিৎ চৌবে দাবি করেন, ‘‘আমরা মাঠে নেমে কাজ করি। আগের চেয়ে প্রতি বছর নাবালিকা বিয়ে করার প্রবণতা কমছে। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী বা সরকারের অন্য প্রকল্পের জন্য বাবা-মায়েরা কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন না। কিন্তু অতিমারির সময় থেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার প্রবণতা ছাত্রীদের মধ্যে বেড়েছে।’’ ইউনিসেফ-কর্তারাও মনে করেন, নাবালিকা বিয়ে রোধে পূর্ব বর্ধমান জেলায় তৎপরতা রয়েছে। সমাজকর্মীদের মতে, পূর্ব বর্ধমানের মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীনচেতা ও আর্থিক ভাবে সক্ষম। তাই ভালবেসে বা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ের প্রবণতা বেশি। সে কারণে ফের ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ পুনর্গঠন, মেয়েদের নানা রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া, আত্মরক্ষার পাঠ দেওয়ার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সদস্য, ভাতা পাওয়া পুরোহিত ও ইমামদের সচেতন করা হবে বলেও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।