গোপালমাঠে চলছে ‘লকডাউন’। শুনশান রাস্তাঘাট। বৃহস্পতিবার। ছবি: বিকাশ মশান
১৩ মার্চ, সালানপুরের ডাবর। ২৮ জুলাই, সালানপুরের রূপনারায়ণপুর…।— মন ভাল নেই আসানসোলের। পুলিশের খাতা ঘাঁটলে আসানসোলের নানা প্রান্ত থেকে এমন একের পরে এক আত্মহত্যার কথা পাওয়া যাচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই প্রবণতারই ছায়া দেখা গিয়েছে ২০১৯-এ শহরের আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে।
‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র তথ্য অনুযায়ী, দেশের শহরাঞ্চলের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনায় আসানসোল দ্বিতীয় স্থানে। ওই বছরে আত্মহত্যা করেছেন শহরের ৪৬৯ জন (পুরুষ ৩৫১ জন, মহিলা ১১৮ জন)। আত্মহত্যার হার ৩৭.৮ শতাংশ। শতাংশের বিচারে এর আগে একমাত্র কেরলের কোল্লাম (৪১.২০ শতাংশ)। অথচ, দেশের আত্মহত্যার হার, ১০.৪০ শতাংশ। শহরের ডাক্তারদের কাছে আরও একটি চিন্তার বিষয় আত্মহত্যা বৃদ্ধির হারটি। ২০১৮-য় আসানসোলে আত্মঘাতী হয়েছিলেন ৩৯১ জন। ২০১৯-এ তা বেড়েছে ১৯.৯০ শতাংশ।
মূলত কী কী কারণে আসানসোলের বাসিন্দারা আত্মহত্যা করেছেন, তারও হদিস মিলবে প্রকাশিত তথ্যভাণ্ডার থেকে। সেখানে মোট সাতটি কারণ বলা হয়েছে— বৈবাহিক টানাপড়েন (আট জন, সবাই মহিলা), পারিবারিক সমস্যা (৯১ জন/ পুরুষ ৮১ জন, মহিলা ১০ জন), অসুস্থতা (২৭২ জন/ পুরুষ ২০০, মহিলা ৭২), সামাজিক সুনাম হারানো (১২ জন/ সবাই পুরুষ), প্রেম-সহ অন্য সম্পর্কগত কারণ (১০ জন/ পুরুষ ৩, মহিলা ৭), জীবিকাগত (দু’জন/ দু’জনেই পুরুষ) এবং অজ্ঞাত কারণ (৭৪ জন/ পুরুষ ৫৩, মহিলা ২১)।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা শহরের মন-মর্জির এমন হাল কেন, তা-ও সন্ধান করতে চাইছেন। আসানসোল জেলা হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেবীপ্রসাদ চৌধুরী জানান, মাদকাসক্তি থেকে সাধারণত অল্পবয়সিদের মধ্যে, ভয় বা লজ্জা লুকনোর কোনও উপায় না পেলে, নিঃসঙ্গতার কারণে বিশেষত প্রবীণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। তাঁর মতে, “যে কোনও বয়সের মানুষ অবস্থার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যা করতে পারেন। কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা ও মনের জোর কমে গেলে এই প্রবণতা আসে।” আসানসোলের আরও এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নন্দ বন্দোপাধ্যায় জানান, শিল্পাঞ্চলে এখন কারখানার সংখ্যা কমছে। বেসরকারি বা সরকারি সব ক্ষেত্রেই কর্মী সংখ্যা কমছে। ফলে, আয়ের উৎস কমছে। কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিক। এই অবস্থায় মানসিক অবসাদ বাড়ছে বলে আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে।
বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় পুলিশও। আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসিপি(সেন্ট্রাল) সায়ক দাস জানান, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এটা পরিষ্কার, মানসিক অবসাদ থেকেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। নিঃসঙ্গ প্রবীণদের পাশে দাঁড়াতে বিশেষ পদক্ষেপ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। কিন্তু আত্মহত্যার ঘটনার সঙ্গে যুঝতে পুলিশ নিজে কতটা প্রস্তুত? কমিশনারেট জানাচ্ছে, মাদকাসক্ত ব্যাক্তিদের মানসিক অবসাদ কাটাতে তাঁদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি, আত্মহত্যার ঘটনার তদন্ত করেন যাঁরা, সেই সব পুলিশকর্মী, আধিকারিকদের কলকাতার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পাঠানো হয়। এ ছাড়া, মাঝে-মধ্যে মহিলা থানা ও টাউন থানার উদ্যোগে কাউন্সেলিংও করানো হয়।
সরকারি স্তরে মনোরোগের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা কতটা, সেই পরিসরটির খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, আসানসোল জেলা হাসপাতালে দু’জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা দু’জনেই বর্তমানে অসুস্থ থাকায় ছুটিতে রয়েছেন। হাসপাতালের সুপার নিখিলচন্দ্র দাস জানান, এই পরিস্থিতিতে রোগীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করানো যাচ্ছে না। বার্নপুরের ইস্কো হাসপাতালে এক জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন। সংস্থার ডিরেক্টর হেলথ সার্ভিসেস রিণ্টু গুহনিয়োগী বলেন, ‘‘প্রয়োজন হলেই শ্রমিক কর্মীদের মানসিক ভাবে সবল করে তুলতে পদক্ষেপ করা হয়। কোভিড পরিস্থিতিতে অনলাইন-যোগাভ্যাস করানো হচ্ছে।’’ পূর্ব রেলের আসানসোল ডিভিশনাল হাসপাতালে এক জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সুপার বিশ্বজিৎ ঘটক। তিনি জানান, ওই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে কর্মীদের সময়-সুযোগ বুঝে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ডিআরএম কার্যালয়ের কর্মীদের জন্য প্রায় দিনই বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে যোগাভ্যাসের ব্যাবস্থা করা হয়।
তবে চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্ত মনে করেন, “অবসাদ, আত্মহত্যার সঙ্গে লড়তে হলে, সবার আগে দরকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সে কাজটাই ব্যক্তিগত পরিসর থেকে শুরু হোক।”