বোরো ধান কাটার কাজ চলছে মন্তেশ্বরে। নিজস্ব চিত্র।
বকেয়া মিলিয়ে পাওয়ার কথা ছিল ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু কেউ পেলেন চার হাজার, কেউ দু’হাজার টাকা। রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ বলে পরিচিত পূর্ব বর্ধমানের চাষিদের একটা বড় অংশের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মাননিধি প্রকল্পে পাওয়া এই টাকায় যে তাঁদের বিশেষ সুরাহা হবে, তা নয়।
কেন্দ্রীয় ওই প্রকল্পে বছরে তিন কিস্তিতে ছ’হাজার টাকা মেলার কথা। এ বার ভোটের প্রচারে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এ রাজ্যের কৃষকদের গত তিন বছরের জন্য ১৮ হাজার টাকা এক সঙ্গে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তৃণমূল ফের সরকার গড়ার পরে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারকে কৃষকদের অ্যাকাউন্টে সে, টাকা দেওয়ার আর্জি জানিয়ে চিঠি দেন। শুক্রবার রাজ্যের কৃষকদের অ্যাকাউন্টে তার একাংশ এসেছে বলে জানা গিয়েছে।
পূর্ব বর্ধমান জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা যায়, জেলার ৫৭,৭৪৮ জন চাষির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছেছে। জেলার কৃষি-কর্তাদের একাংশের অনুমান, যে চাষিদের নাম এপ্রিলের আগে নথিভুক্ত হয়েছিল, তাঁরা দু’কিস্তির মোট চার হাজার টাকা এবং যাঁদের নাম এপ্রিলের পরে নথিভুক্ত হয়েছে, তাঁরা এক কিস্তির দু’হাজার টাকা পেয়েছেন। কৃষি দফতরের উপ-কৃষি অধিকর্তা জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য শনিবার বলেন, ‘‘এই বিষয়টি আমরা নির্দিষ্ট করে এখনও কিছু জানতে পারিনি।’’
চাষিরা জানান, এক বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করতে জমি তৈরিতে প্রায় ৭০০ টাকা, বীজতলা থেকে মূল জমিতে চারা পোঁতার জন্য শ্রমিক বাবদ প্রায় ১,৮০০ টাকা, রাসায়নিক সার বাবদ প্রায় ১,৪০০ টাকা, কীটনাশকের জন্য ৬০০ টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া, আগাছা পরিষ্কার থেকে ধান কাটার জন্য শ্রমিক বাবদ প্রায় ২,৩০০ টাকা এবং সেচের জল কিনতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। অন্যের জমিতে চুক্তিতে চাষ করলে বিঘা প্রতি দিতে হয় তিন বস্তার দাম। যার বর্তমান বাজারমূল্য ২,৬৫০ টাকা। এর পরে, ধান তুলে ঝেড়ে গোলা অবধি আনতে যন্ত্র ভাড়া, শ্রমিক ও গাড়িভাড়া মিলিয়ে আরও হাজার তিনেক টাকা খরচ। সব মিলিয়ে, এক জন ভাগ চাষির বিঘা প্রতি জমিতে বোরো ধান চাষ করতে খরচ প্রায় ষোলো হাজার টাকা।
আনাজ চাষিদের থেকে জানা যায়, এক বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করার জন্য চারা কিনতেই খরচ প্রায় আড়াই হাজার টাকা। জমি তৈরির জন্য ট্রাক্টর বাবদ খরচ এক হাজার টাকা, সার ৩,৬০০ টাকা, জৈব সার হাজার দু’য়েক টাকা, কীটনাশক তিন-চার হাজার টাকা। সব মিলিয়ে, খরচ প্রায় ১২-১৩ হাজার টাকা।
নাদনঘাটের রাজীবপুর এলাকার চাষি জাকির হোসেন মল্লিক বলেন, ‘‘আমাদের এক বিঘা জমিতে ধান চাষে শ্যালো পাম্পে সেচের জলের জন্য খরচ হয় ৩,৮০০ টাকা। অ্যাকাউন্টে যে চার হাজার টাকা এসেছে, তা সেচের জলের জন্যই বেরিয়ে যাবে।’’ ১৮ হাজার টাকা পেলে চাষে অনেকটা সুরাহা হত, দাবি তাঁর। আর এক ধান চাষি জগন্নাথ ঘোষ জানান, তিনি দু’হাজার টাকা পেয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘এখন এক বিঘা জমির ধান তুলে ঝেড়ে গোলায় আনতেই প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা খরচ। আপাতত বস্তা পিছু (৬০ কেজি) ধান বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। খরচ মেটাতে চাষিদের বাধ্য হয়ে কম দামেই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। ১৮ হাজার টাকা এক লপ্তে হাতে পেলে এত কম দামে বিক্রি না করলেও চলত।’’ দু’হাজার টাকায় বড়জোর সার-কীটনাশকের খরচ জুটবে, দাবি তাঁর।
চাষিরা জানান, সারের দাম বাড়ছে। আনাজ চাষি অনিতা পালের কথায়, ‘‘দেড় মাস আগে যে সারের দাম ছিল বস্তা প্রতি ১,২০০ টাকা, এখন তা প্রায় ১,৯০০ টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে বিভিন্ন চাষের জন্য গড়ে দু’বস্তা ডিএপি সার দরকার। প্রকল্পে পাওয়া চার হাজার টাকায় তাই বিশেষ সুবিধা হবে না।’’ তবে প্রান্তিক আনাজ চাষিদের একাংশের দাবি, এখন সীমিত সময় বাজার খোলা থাকা, ট্রেন না চলার মতো নানা কারণে পাইকারি বাজারে বিভিন্ন আনাজের দাম ক্রমে কমছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারি সাহায্যের চার হাজার টাকা কাজে আসবে।
তৃণমূলের রাজ্যের অন্যতম মুখপাত্র দেবু টুডুর মন্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথামতো চাষিদের পাওয়ার কথা ছিল ১৮ হাজার টাকা। পেলেন দুই বা চার হাজার টাকা করে। তা-ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইয়ের জন্য। প্রধানমন্ত্রী প্রচারে এসে যে ভাঁওতা দিয়েছিলেন, তা প্রমাণ হয়ে গেল।’’ বিজেপির কিসান মোর্চার জেলা সভাপতি আনন্দ রায়ের পাল্টা দাবি, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কথা রেখেছেন। ভোটে বাংলায় কী ফল হয়েছে তা না ভেবেই উনি চাষিদের জন্য টাকা পাঠাতে শুরু করেছেন।’’
জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই প্রকল্পে নথিভুক্ত চাষির সংখ্যা বর্তমানে এক লক্ষ ২১ হাজার। বিভিন্ন ব্লকে এখনও পড়ে রয়েছে বহু আবেদন। ব্লক কৃষি দফতরগুলি থেকে ওই আবেদনগুলিতে অনুমোদন দেওয়া হলে সংখ্যাটা দাঁড়াবে প্রায় দু’লক্ষের কাছাকাছি। দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘মাঝে বিধানসভা ভোটের জন্য কাজ বন্ধ ছিল। আচমকা এ ভাবে কেন্দ্র সরকার টাকা দিয়ে দেবে তার জন্যও দফতর তৈরি ছিল না। ইদ এবং অক্ষয় তৃতীয়া উপলক্ষে ছুটিও ছিল। তা সত্ত্বেও ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে।’’
কিন্তু প্রকল্পে নাম থাকা সকলে টাকা পাননি কেন? কৃষি দফতরের উপ-কৃষি অধিকর্তা জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট করে এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে আমাদের ধারণা, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এক সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার কারণে অনেক অ্যাকাউন্টের আইএফএসসি কোডের পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে, টাকা পৌঁছতে সমস্যা হয়েছে।’’