পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।
কেটেও কাটছে না জট। রত্না চট্টোপাধ্যায়কে বেহালা পূর্বের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে তৃণমূল সরাতেই শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘর ওয়াপসি’র জল্পনা দাবানলের মতো ছড়িয়েছিল। কিন্তু বুধবার বিকাশ ভবনে হওয়া এক বৈঠকে তিক্ততা ফের তুঙ্গে উঠল। বৈঠকে তাঁকে সাংঘাতিক অপমানিত হতে হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। খোদ শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধেই আঙুল তুললেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য সে অভিযোগ নস্যাৎ করেছেন। ‘‘বৈশাখীকে আমি যথেষ্ট স্নেহ করি এবং গুরুত্ব দিই। তাঁর কেন এ রকম মনে হয়েছে, আমি জানি না’’, মন্তব্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের।
বৈশাখী যে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা, সেই মিল্লি আল আমিনে দীর্ঘ দিন ধরে অচলাবস্থা চলছে। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা হিসেবে মেনে নিতে কলেজটির পরিচালন সমিতি নারাজ। শিক্ষা দফতর তথা শিক্ষামন্ত্রী প্রকাশ্যে অন্তত বৈশাখীর পাশে দাঁড়ানোর বার্তাই দিয়ে এসেছেন বার বার। কিন্তু একের পর এক বৈঠকেও সমাধান সূত্র অধরাই থেকেছে। ‘‘শিক্ষামন্ত্রী যদি সত্যিই চাইতেন যে, কলেজটার এই অচলাবস্থা কেটে যাক, তা হলে কি অচলাবস্থা এত দিন ধরে বহাল থাকতে পারত?’’ আগেও একাধিক বার এই প্রশ্ন তুলেছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু মঙ্গলবার তিনি তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। সরাসরি ‘অপমান’ করার অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে।
বিকাশ ভবনে এ দিনের বৈঠকে মিল্লি আল আমিন কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্যরা ছিলেন। ছিলেন অধ্যক্ষা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বৈঠকের শুরুতেই বৈশাখীকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ‘করোনা ভাইরাস’-এর সঙ্গে তুলনা করেন বলে অভিযোগ। পরে বৈঠক চলাকালীন পরিচালন সমিতির সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষার বাদানুবাদ তুঙ্গে ওঠে বলে খবর। সেই বাদানুবাদ থামাতে গিয়েও শিক্ষামন্ত্রী পরিচালন সমিতির পক্ষই নেন এবং অধ্যক্ষাকে ‘নমনীয়’ হওয়ার নির্দেশ দেন বলে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: শোভনের উদ্দেশে ইঙ্গিত, রত্নাকে দায়িত্ব থেকে সরাল তৃণমূল
বিকাশ ভবনের বৈঠকে কী চলছে, সে খবর শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও পৌঁছয়। তিনি বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবিলম্বে বিকাশ ভবন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন বলে খবর। তার পরে বৈশাখী বেরিয়েও যান। বৈশাখীর কথায়, ‘‘যে অপমানের মুখে আজ আমাকে ফেলা হয়েছে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তেমন কিছু পেতে হবে, আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। অপমানে যখন আমার চোখে জল এসে গিয়েছে, তখন মন্ত্রী বাকিদের সঙ্গে হাসি-মস্করায় মজে থেকেছেন।’’
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য ‘অপমান’ করার অভিযোগ সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছেন। আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি বুঝতেই পারছি না, এই অভিযোগ কেন তোলা হচ্ছে? বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার অত্যন্ত সুসম্পর্ক। তাঁকে আমি যথেষ্ট স্নেহ করি। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও আমি বরাবর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। এর পরেও তাঁর কেন মনে হচ্ছে যে, আমি তাঁকে অপমান করতে পারি, আমার জানা নেই।’’
আরও পড়ুন: নবান্নে বৈঠকের পরেও নিস্পৃহ শোভন শিবির, পাল্লা ভারী গেরুয়ারই
কিন্তু মিল্লি আল আমিন কলেজের সমস্যা যে দীর্ঘ দিন ধরে মিটছে না, সে কথাও তো সত্য। শিক্ষামন্ত্রী যদি সত্যিই চান সমস্যা মিটে যাক, তা হলে কি এখনও তো বহাল থাকতে পারত? পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সমস্যা যদি মেটাতে না চাইতাম, তা হলে এত বার ওই কলেজকে নিয়ে আমি বৈঠকে বসব কেন? আর কোনও কলেজকে নিয়ে এত বার বৈঠক করেছি। কোনও শিক্ষামন্ত্রী কখনও একটা কলেজের সমস্যা মেটানোর জন্য এত সময় ব্যয় করেছেন? এর পরেও যদি কারও মনে হয় যে, আমি সমস্যা মেটাতে চাইছি না, তা হলে তিনি আমাকে ভুল বুঝছেন।’’ বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অল্পেই অভিমান করেন’ এবং ‘অভিমান’ থেকেই তিনি এই রকম অভিযোগ তুলছেন বলেও পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন মন্তব্য করেছেন।
শোভন ঘনিষ্ঠরা অবশ্য তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন। তাঁদের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হওয়ার পরেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় রুষ্ট হয়েছে। যত দিন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় শুধুমাত্র শিক্ষামন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে ছিলেন, তত দিন শিক্ষামন্ত্রী ভাল ব্যবহার করেছেন, কিন্তু বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসায় পার্থ রুষ্ট হয়েছেন এবং এই বৈঠকে বৈশাখীকে নানা ভাবে অপদস্থ করেছেন— দাবি শোভন ঘনিষ্ঠদের কারও কারও।
এই অভিযোগ প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায় কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘কলেজের সমস্যায় যে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের রক্ষক হিসেবে আমি কাজ করেছি, তাঁর সঙ্গে আমি শত্রুতা করছি বলে যদি কেউ অভিযোগ করেন, তা হলে আমি সে কথার জবাব দিতে চাই না। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই জানেন, আমি কী কী করেছি।’’ পার্থ চট্টোপাধ্যায় এর বেশি কিছু বলতে না চাইলেও তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের নেপথ্যেও পার্থবাবু সেতু হিসেবে কাজ করেছিলেন।
শোভন চট্টোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট বলে কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বিভিন্ন জট কাটিয়ে তাঁর দলের ফেরার পথ প্রশস্ত করতে চাইলেও, দলেরই অন্য একটা অংশ জটিলতা বাড়াতে সচেষ্ট বলে শোভন ঘনিষ্ঠদের দাবি। সেই কারণেই বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্যা আচমকা বাড়িয়ে তোলা হল বলেও অভিযোগ করছেন শোভনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা কেউ কেউ। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আমি বরাবরই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উপরে অগাধ ভরসা রেখে চলেছি। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে তাঁকে বিশ্বাস করেছি, তাঁর কথায় আস্থা রেখেছি। এতটা বিশ্বাস করতে অনেকেই আমাকে বারণ করেছিলেন। আমি গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু আজ যে অপমান নিয়ে আমাকে বিকাশ ভবন থেকে বেরতে হল, তাতে মনে হচ্ছে, শুভানুধ্যায়ীদের কথায় অনেক আগেই আমার গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে যেমন কোয়রান্টিনের দরকার পড়ছে, তেমন আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, স্বেচ্ছায় কোয়রান্টিনে গিয়ে নিজেকে এই কলেজ থেকে সরিয়ে নেব।’’