নিহত করসেবকদের বাড়িতে কৈলাস বিজয়বর্গীয়। নিজস্ব চিত্র
মুখ খোলেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপ্রিম কোর্টের অযোধ্যা রায় প্রসঙ্গে তৃণমূলও কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। শনিবার রাতে শুধু ফেসবুকে নিজের একটা কবিতা পোস্ট করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সে কবিতার কয়েকটা লাইন অযোধ্যা রায়ের প্রেক্ষিতে বেশ তাৎপর্যপূর্ণও। কিন্তু অযোধ্যা বা রামজন্মভূমি বা বাবরি মসজিদের নাম গত দু’দিনে উচ্চারণই করেনি এ রাজ্যের শাসক দল। রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা বিজেপি হাঁটছে উল্টো পথে। রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা দফায় দফায় ছুটতে শুরু করেছেন রামমন্দির আন্দোলনে নেমে নিহত হওয়া কলকাতার দুই করসেবকের বাড়ি। রবিবার বড়বাজারের রামমন্দিরে গিয়ে পুজোও দিয়েছেন রাজ্য বিজেপির একাধিক নেতা।
বিজেপি যে অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির পক্ষেই ছিল, তা বলতে বিজেপি কখনও দ্বিধা করেনি। বরং দশকের পর দশক ধরে বিজেপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ঠাঁই পেয়েছে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ। তাই সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে যে সর্বত্রই বিজেপি নেতারা ঘটা করে স্বাগত জানাবেন, তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানান। বিজেপি যে এই রায়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট, তা দিলীপ বুঝিয়ে দেন।
কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। শনিবার দুপুর থেকেই বিজেপি নেতারা বার বার ছুটে যেতে শুরু করেছেন বড়বাজার এলাকার খেলাত ঘোষ লেনের একটি বাড়িতে। কোঠারি পরিবারের বাড়ি। ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশে মৃত্যু হয় এই পরিবারের দুই সদস্য রাম কোঠারি এবং শারদ কোঠারির। বজরঙ্গ দলের সক্রিয় কর্মী তথা কলকাতার ওই দুই করসেবক সে সময়ে উত্তরপ্রদেশে গিয়েছিলেন রামমন্দির আন্দোলনে অংশ নিতে। গুলিতে মৃত্যু হয় তাঁদের। তাই রাম কোঠারি আর শারদ কোঠারিকে ‘শহিদ’ আখ্যা দেয় বিজেপি। সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির তৈরির নির্দেশ দিতেই সেই ‘শহিদ’দের কথা মনে পড়ে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের। কোঠারিদের বাড়ি গিয়ে গতকাল থেকেই রাম ও শারদের ছবিতে মালা দিচ্ছেন বিজেপি নেতারা, শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।
নিহত করসেবকদের বাড়িতে প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুব্রত চট্টোপাধ্য়ায়
আরও পড়ুন: বুলবুলের রোষে কাকদ্বীপ, ঝড়ের দাপটে এলাকা তছনছ, বিদ্যুৎহীন বহু জায়গা
শনিবার সর্বাগ্রে কোঠারিদের বাড়ি যান রাজ্য বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। তিনি ঘুরে আসার পরেই যান রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সুব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার ফের রাম-শারদকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলেন তিন বিজেপি নেতা— সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত, রাজ্য স্তরের নেতা শিশির বাজোরিয়া এবং যুব নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা।
রবিবার সন্ধ্যায় বড়বাজারে রামমন্দিরে সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত-সহ বিজেপির অন্যরা। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রে সরকার গড়ার দাবি থেকে সরল বিজেপি, যে কোনও মূল্যে মুখ্যমন্ত্রীপদ চায় সেনা
শুধু কোঠারিদের বাড়ি গিয়ে ‘শহিদ’দের শ্রদ্ধা জানিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি এ রাজ্যের বিজেপি নেতারা। রবিবার তাঁরা বড়বাজারের রামমন্দিরেও যান। বিতর্কিত জমিতে মন্দির তৈরির রায় এসেছে বলেই যে, স্বপন দাশগুপ্ত, শিশির বাজোরিয়ারা এ দিন ঘটা করে রামমন্দিরে গেলেন, তা নিয়ে কোনও মহলেই সংশয় নেই। বিজেপি অঘোষিত ভাবে অযোধ্যা রায়ের উদ্যাপন শুরু করতে চাইছে বলে রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ মনে করছে।
ঠিক বিপরীত ছবি তৃণমূল শিবিরে। অযোধ্যা মামলার বিষয়ে যা মন্তব্য করার মমতাই করবেন, দলের অন্য কারও মুখ খোলার দরকার নেই— এই বার্তা গোটা দলের কাছেই ছিল। সকলে অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন সে কথা। কেউ মুখ খোলেননি। কিন্তু রায়ের দিনে বা তার পরের দিনে মুখ খুললেন না মমতা নিজেও। দেশের যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যিনি নিজের মতামত জানাতে অভ্যস্ত, সেই মমতা কেন মুখ খুললেন না? তিনি কি কোনও পক্ষেরই বিরাগভাজন হতে চাইছেন না? প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক শিবিরে। কিন্তু শনিবার রাতে নিজের ফেসবুক পেজে যে কবিতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পোস্ট করেছেন, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
কবিতাটার নাম ‘না বলা’। প্রথম কয়েকটি লাইন হল— ‘অনেক সময় / কথা না বলেও / অনেক কথা বলা হয়ে যায়। / কিছু বলার থেকে / না বলাটা / আরও শক্তিশালী বলা।’ কবিতার শেষ কয়েকটা লাইনে মমতা লিখেছেন— ‘আর না বলতে পারাটা / অতীব যন্ত্রণা / ওটা তো হৃদয়ের শক্তিশেল— / জমা থাকে।’
শনিবার নিজের ফেসবুক পেজে এই কবিতাই পোস্ট করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়
আরও পড়ুন: অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরিতে লাগতে পারে ৫ বছর! শুধুই পাথর, থাকবে না সিমেন্ট-বালি-রড!
এই কবিতায় মমতা ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক শিবিরে। এর আগেও একাধিক বার কবিতার মাধ্যমে নিজের বার্তা বুঝিয়েছেন মমতা। এ বারের কবিতাও কি সে রকমই কিছু? এই প্রশ্ন উঠেছে স্বাভাবিক ভাবেই। কী বলতে না পারার কথা তিনি লিখেছেন? কী ‘জমা’ রাখছেন? যদি ‘জমা’ই থাকে, তা হলে কি উপযুক্ত কোনও সময়ে মুখ খোলার কথা ভাবছেন? এমন নানা চর্চা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে।