গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিষয়টি প্রতীকী। কিন্তু সেটাই যদি প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়? যেমন হয়েছিল ২০০৭-’০৮ সালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে। অথবা হয়েছিল ২০২১-’২২ সালে কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে। আরজি কর-কাণ্ডে ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকার প্রদেয় সম্মান ফেরানোর কথা ঘোষণা করতে শুরু করেছেন শিক্ষক এবং নাট্যব্যক্তিত্বেরা। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সেই সংখ্যাটা খুব বেশি নয়— তিন। কিন্তু এর পর তা ‘সংক্রমিত’ হলে ‘চাপে’ থাকা শাসক তৃণমূল তথা রাজ্য সরকারের ‘বিড়ম্বনা’ আরও বাড়বে।
গত সপ্তাহেই আলিপুরদুয়ারের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পরিমল দে ‘বঙ্গরত্ন’ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরূপই তিনি তা প্রত্যাখ্যান করার কথা জানিয়েছিলেন। নাট্যক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দীনবন্ধু মিত্র পুরস্কার’ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন নাট্যকার চন্দন সেন। ‘অন্ধ আনুগত্য’ না মানার কথা জানিয়ে নাট্য অ্যাকাডেমির দেওয়া সেরা নির্দেশকের পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের কথা ঘোষণা করেছেন নির্দেশক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়। কার্টুনিস্টদের একটি সংগঠনও তাঁদের কর্মসূচির জন্য পাওয়া সরকারি অনুদান ফিরিয়ে দিয়েছে বলে খবর।
বাম জমানার শেষ পর্বে নন্দীগ্রামের ‘হিংসা’, ‘পুলিশি সন্ত্রাস’-সহ বিভিন্ন অভিযোগে সরকারি কমিটি ছেড়ে বেরিয়ে আসা, পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের ঘটনা দেখা গিয়েছিল। এর পরেই বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে, বিষয়টি কি ছোঁয়াচে হচ্ছে? ক্রমে যদি এই তালিকা দীর্ঘ হয়, তা কি শাসকদলের জন্য আরও বিড়ম্বনার হবে?
কোনও ঘটনার প্রতিবাদে রাষ্ট্রীয় সম্মান বা সরকারি পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের রেওয়াজ নতুন নয়। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতেও সরকারি সম্মান ফেরানোর নজির রয়েছে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির পরে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেকেই রাষ্ট্রীয় সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গ রাজনীতিতে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান এবং সরকারি কমিটি ছেড়ে বেরিয়ে আসার ঘটনা পর পর ঘটেছিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে। হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তীরা নাট্য অ্যাকাডেমি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। অধুনাপ্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ বাংলা অকাদেমির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। আবার কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যখন দিল্লির উপকণ্ঠে কৃষকদের টানা আন্দোলনে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘দমনপীড়নের মনোভাব’-এর প্রতিবাদে অনেক কৃতী পদ্মসম্মান প্রত্যখ্যানের কথা ঘোষণা করেছিলেন। সেই তালিকায় ছিলেন ক্রীড়াবিদ থেকে কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতারা।
ইতিহাস বলছে, ২০০৭-’০৮ সালের ওই ঘটনার পরে ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে ভোটে বিপর্যয় হতে শুরু করেছিল সিপিএমের। শেষপর্যন্ত ২০১১ সালে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। ঠিক যেমন ২০২১-’২২ সালের ঘটনার পরে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে হয়েছে বিজেপিকে। আরজি কর-কাণ্ডের পরে যে নাগরিক আন্দোলন তৈরি হয়েছে রাজ্য জুড়ে, তাতে আগেই ‘চাপ’ তৈরি হয়েছে তৃণমূলের উপর। দলের নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কেরা প্রকাশ্যে হুমকি, হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ কটাক্ষও করছেন। সরকারি পুরস্কার নিয়ে তৃণমূল বিধায়ক তথা অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিক এমনই এক কটাক্ষ করে কার্যত ‘একঘরে’ হয়ে পড়েছিলেন। ক্ষমা চেয়ে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করলেও দুই নাট্যব্যক্তিত্ব কাঞ্চনের মন্তব্যের প্রতিবাদেই তাঁদের সরকারি পুরস্কার ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এই ‘প্রবণতা’ যদি ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে তা তৃণমূলের পক্ষে খুব ‘স্বস্তিদায়ক’ হবে না।
প্রবীণ তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায়ের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘এ সব কোনও চাপ তৈরি করতে পারে না। একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ তাঁদের অবস্থান নিচ্ছেন। এটাকে চাপ ভাবলে চাপ। না ভাবলে নয়। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।’’ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান প্রতীপ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘মুষ্টিমেয় শিক্ষিত অংশের কাছে এর প্রভাব থাকলেও গ্রামবাংলার সাধারণ জনজীবনে এর কোনও প্রভাব পড়ে না।’’
তবে উল্টো অভিমতও রয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ত্রিদিব চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘একজন, দু’জন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলে তার অভিঘাত খুব একটা হয় না। তবে পর পর হতে থাকলে শাসক চাপে পড়তে পারে।’’ তবে তিনি এ-ও মনে করেন যে, শাসকদল কখনও সেই প্রভাব বা অভিঘাত প্রকাশ করে না। কারণ, সেটাই শাসকের চরিত্র।
বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘বিভিন্ন ভাবে মানুষ বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চাইলেও জালিয়ানাওয়ালাবাগের ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সহায়তা করেননি। তখন বিশ্বকবি ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগকে তাঁর হাতিয়ার করেছিলেন। সেই ঘটনার সঙ্গে এখনকার তুলনা হয় না ঠিকই, তবে এখন পশ্চিমবঙ্গের যা পরিস্থিতি, তাতে সকলেই প্রতিবাদ করছেন। তৃণমূলের ভিতর থেকেও প্রতিবাদ উঠে আসছে।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘সমাজের সর্ব স্তর থেকে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। আমার রাজনৈতিক জীবনে এ রকম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখিনি। আরজি কর-আন্দোলন সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এই ক্ষত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এবং তাঁর দলের জন্য চিরকালের হয়ে গেল। কিছু একটা হলেই এই ক্ষোভের উদ্গীরণ হবে।’’ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘পুরস্কার বা কোনও সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সম্মান ফেরানো সামাজিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করে। সেই আন্দোলনকে আরও গতিশীল করতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। সেটাই হচ্ছে এবং হবেও।’’