তারক চন্দ্র
এ রাজ্যে দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের জন্য ব্রেলে লেখা বই পাওয়া যায় দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। স্বভাবতই, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকাংশ পড়ুয়াকে হোঁচট খেতে হয় পদে পদে। তাঁদের সেই সমস্যা কাটাতে এগিয়ে এসেছেন এক স্কুলশিক্ষক। যিনি নিজেও দৃষ্টিহীন।
উত্তর ২৪ পরগনার গুমার বাসিন্দা তারক চন্দ্র জন্মান্ধ। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন টালিগঞ্জের লাইটহাউস ফর দ্য ব্লাইন্ডে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন হাবড়া হাইস্কুল থেকে। এর পরে বারাসত সরকারি কলেজ থেকে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক। লড়াইটা সেখানেই থেমে যায়নি। পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়েই স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন তারক। সেখান থেকে পাশ করে তিনি এখন মধ্যমগ্রামের একটি স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক।
পড়াশোনার এই দীর্ঘ পথে তাঁর পড়ার, বোঝার মতো বইয়ের অভাব বার বার অনুভব করেছেন তারক। তিনি জানালেন, এমনিতেই দৃষ্টিশক্তি নেই বলে কিছুটা অসুবিধা থাকে। তার উপরে পড়তে গিয়ে যদি বই-ই পড়তে না পারা যায়, তা হলে অসুবিধার মাত্রা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তারক জানালেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লেকচার শোনার পাশাপাশি ‘রিডার’ দিয়ে পাঠ্যসূচি রেকর্ড করে নিতেন। সেই রেকর্ডিং শুনে পড়াশোনা চালিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘এ ভাবে পড়া চালিয়ে যাওয়া যে কতটা কঠিন, আমি জানি। তাই এ বার অডিয়ো বই তৈরির কাজে এগোচ্ছি। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত অডিয়ো বই তৈরির ইচ্ছে রয়েছে।’’ তারকের এই কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন পরিচিত বেশ কয়েক জন।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরপর দু’টি বিষয়ে স্নাতক হয়েছেন পঙ্কজ সিংহ। ইতিহাসের পরে সম্প্রতি সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করে স্নাতক হয়েছেন দৃষ্টিহীন পঙ্কজ। এ বার দূরশিক্ষার মাধ্যমে সঙ্গীতে এমএ করতে চান। দৃষ্টিহীনদের জন্য অডিয়ো বই তৈরিতে এক জন উদ্যোগী হয়েছেন শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এর থেকে ভাল প্রচেষ্টা আর হতে পারে না।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পিএইচডি করছেন যীশু দেবনাথ। তিনিও জানালেন, দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে খুবই প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। তবে যাদবপুরে ব্রেল পদ্ধতিতে ছাপানোর যন্ত্র আছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা তাঁদের স্টাডি মেটেরিয়াল ব্রেলে ছাপিয়ে নিতে পারেন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ব্রেল লাইব্রেরি। তবে যাদবপুরের মতো সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এক নয়। এর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট অ্যাপে ই-বইও শোনা যায়। কিন্তু সকলে এত কিছুর সুবিধা পান না। তাই তারকের আশা, অডিয়ো বই তৈরি হলে বহু দৃষ্টিহীন পড়ুয়া উপকৃত হবেন।
তারক জানালেন, তাঁদের এই প্রচেষ্টায় প্রথমে দরকার হচ্ছে দু’টি কম্পিউটার এবং অন্তত দু’জন ‘রিডার’। রিডারেরা বইগুলি পড়ে তা রেকর্ড করবেন। এর সঙ্গে প্রয়োজন যাবতীয় পাঠ্যবই। পাশাপাশি নেট, ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষার পাঠ্যসূচি নিয়েও অডিয়ো বই তৈরির পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে। কিছু বই অন্তত যাতে সাধারণ মানুষ দেন, তা হলে খুবই ভাল হয় বলে জানালেন তারক। দুই ‘রিডার’-এর পারিশ্রমিক জোগাড়েরও চেষ্টা চলছে। তারকের কথায়, ‘‘সব ব্যবস্থা হয়ে গেলেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বিনামূল্যে এই অডিয়ো বই পাঠাতে পারব।’’