ধর্মতলার মঞ্চে অভিষেকের মুখোমুখি শুভাপ্রসন্ন। — নিজস্ব চিত্র।
বৃহস্পতিবার রাতেও তিনি জানতেন না আমন্ত্রণ পাবেন কি না। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ডাক পেলেই তিনি যেতে চান। আবার এ-ও বলেছিলেন যে, তিনি অপেক্ষায় নেই। কিন্তু শুক্রবার দুপুরে তৃণমূলের মঞ্চে দেখা গেল মেরুন পাঞ্জাবি পরিহিত শ্বেতশুভ্র দাড়ির শিল্পী শুভাপ্রসন্নকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখিও হন। তবে একেবারে এক মুহূর্তের জন্য। মমতাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাত বাড়ান শুভাপ্রসন্ন। মমতা বাকিদের মতো শুভাপ্রসন্নের হাত ধরলেও কোনও কথা বলেননি।
জল্পনা ছিল, সম্প্রতি একাধিক বার তৃণমূলকে অস্বস্তিতে ফেলা শিল্পী ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে ফি বছরের মতো আসবেন কি না! আরও প্রশ্ন ছিল, তৃণমূলের পক্ষ থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না! বৃহস্পতিবার রাতেও তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছিলেন, আমন্ত্রণ আসেনি। তৃণমূল সূত্রে খবর, শুক্রবার সকালে তাঁর কাছে আমন্ত্রণ যায় এবং বেলা ১১টা নাগাদ তিনি মঞ্চে চলে আসেন। চলচ্চিত্র পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী, প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যাম থাপাদের সঙ্গেই মূল মঞ্চে অতিথিদের আসনে জায়গা পেয়েছেন শুভাপ্রসন্ন। তাঁকে মঞ্চে বসান রাজ্যের মন্ত্রী সঙ্গীতশিল্পী ইন্দ্রনীল সেন এবং তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেন।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে তিনি অন্যান্য বিশিষ্টজনের সঙ্গে তৃণমূলের কাছাকাছি আসেন। স্বয়ং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন’ হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই প্রতি বছরই ২১ জুলাই তৃণমূলের ‘শহিদ দিবস’ পালনের মঞ্চে ‘বিশিষ্টদের’ সারিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু এ বার দেখা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেকগুলি কারণে।
সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়েই তো ‘বিবেক’-এর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এমন হিংসা দেখে আবার ‘পরিবর্তন’ চেয়ে মিছিলে হাঁটতে চান। তবে ফলঘোষণার পরেই তিনি মত বদলে ফেলেন। এমনটা আগেও হয়েছে। ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিষিদ্ধ করা বিতর্কে তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়িয়েছিলেন। আবার নিজেই বিতর্ক তৈরি করেছিলেন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর সরকারি অনুষ্ঠানে। ২১ ফেব্রুয়ারি দেশপ্রিয় পার্কে সেই উপলক্ষে রাজ্য সরকারের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই শুভাপ্রসন্ন বলেছিলেন, ‘‘বাংলা ভাষার উচ্চারণ, বাংলা ভাষার তাৎপর্য, বাংলার ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা সরে আসছি। আমরা দেখছি বহু কারণে, নানান সাম্প্রদায়িক ছাপ বাংলা ভাষায় চলে এসেছে।’’ এর পরেই তিনি সটান বলেন, ‘‘যে শব্দগুলোকে আমরা কখনও বাংলা বলি না, ভাবি না, সেই শব্দ এখন বাংলা ভাষায় ঢুকছে। আমরা কোনও দিন বাংলা ভাষায় ‘পানি’ ব্যবহার করি না। আমরা কোনও দিন কখনও ‘দাওয়াত’ দিই না। সুতরাং, ভাবতে হবে কোন ভাষা আমাদের ভাষা।’’
মঞ্চেই শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা স্বয়ং। তিনি বলেন, ‘‘শুভাদা অনেক শ্রদ্ধেয়। কিন্তু শুভাদাকে একটা কথা বলব। দেখুন, কতগুলি শব্দ রয়েছে, যেগুলি সারা বিশ্বের। যেমন ‘মা’ বললে সবাই জানে দু’টি শব্দ রয়েছে। একটা ‘মা’ আর একটা ‘মাদার’। আর একটা শব্দ রয়েছে ‘জল’ বা ‘ওয়াটার’। কিন্তু ওয়াটারকে কেউ কেউ ‘পানি’ বলে। এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। মাকে কেউ ‘আম্মা’ বলে। এটাকে মেনে নিতে হবে। কেউ বারণ করেনি। আমি মা-ও বলব, আমি আম্মাও বলব।’’ মমতা আরও বলেন, ‘‘ওরা অতিথিসেবাকে দাওয়াত বলে। এটা বাংলাদেশের ভাষা। যাঁরা ও পার থেকে এ দেশে এসেছেন, তাঁরা এই ভাষাটাকে গ্রহণ করেছেন। আমি মাতৃভাষাকে চেঞ্জ (বদল) করতে পারি না। যেটা শিখে এসেছে, সেটা চেঞ্জ করবে কী ভাবে।’’
এই বিতর্কের জল অনেক দূর গড়িয়েছিল। মমতাকে তাঁরাই (বিশিষ্টেরা) ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন শুভাপ্রসন্ন। এর পরে শুভাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও ছাড়েনি তৃণমূল। কিন্তু সে সবে যে শিল্পী কিছু মনে করেননি তা জানিয়েছিলেন আনন্দবাজার অনলাইনকে। গত সোমবার ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে থাকবেন কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি কী করে বলব আমন্ত্রণ পাব কি না? আমি তো বিচ্ছিন্ন হইনি!’’ একই প্রশ্ন বৃহস্পতিবার রাতে করা হলে কিছুটা মেজাজও হারান শুভাপ্রসন্ন। বলেন, ‘‘আমি জানি না, আমি যাব কি না!’’ আমন্ত্রণ পেয়েছেন? এই প্রশ্নেই কিছুটা রেগে গিয়ে শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘এটা কি কারও বিয়ে নাকি! যে আমন্ত্রণ পেলে তবেই যাব! ওরা আমাকে প্রতি বছর নিয়ে যায়।’’ তবে কি শুক্রবার সকালে তৃণমূলের গাড়ি আসার অপেক্ষায় থাকবেন? প্রশ্ন শুনে শুভাপ্রসন্ন বলেছিলেন, ‘‘আমার কোনও অপেক্ষা নেই।’’
তিনি সকালে অপেক্ষা করেছিলেন কি না, তাঁর বাড়িতে তৃণমূলের পক্ষে গাড়ি পৌঁছেছিল কি না, তা জানা যায়নি। তবে এটা নিশ্চিত যে, শেষ বেলায় আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তৃণমূলের যা ব্যবস্থা, তাতে বিশিষ্টদের মধ্যে কারা আমন্ত্রণ পাবেন, তা ঠিক করেন স্বয়ং মমতা। তাঁর নির্দেশ মতো বার্তা পৌঁছে দেন অন্য কেউ।
ক’দিন আগেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ‘হিংসা’ নিয়ে মতবদল করে শুভাপ্রসন্ন যখন শাসকের অস্বস্তি কমিয়ে দিয়েছিলেন তখন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘শুভাদার সুমতি হয়েছে। উনি বোধহয় ‘রামের সুমতি’ পড়ছেন এখন।’’ সে ইঙ্গিত বৃহস্পতিবারেও দিয়েছেন শুভাপ্রসন্ন। পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গে অপর্ণা সেন ‘এমন সরকার চাইনি’ বলার পরে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতেই চাননি তিনি। একদা আন্দোলনের সঙ্গী অপর্ণা সম্পর্কে বলেন, ‘‘ওঁর কথা উনি বলেছেন।’’