বাংলার ন’টি জেলায় দাপট চলছে আর্সেনিকের। এ বার রাজ্যের বাইরে বাঙালির অন্যতম প্রিয় শহর বারাণসীর পানীয় জলেও আর্সেনিক হাজির। ওই মারণ বিষের সূত্রে বাংলা আর বারাণসী পরস্পরের সহমর্মী।
এত দিন উত্তরপ্রদেশের ন’টি জেলার ৪৫টি ব্লকে আর্সেনিকের উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছিল কেন্দ্রীয় ভূজল পর্ষদ। দেশের অন্যতম প্রাচীন তীর্থশহর এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসীর নামও এ বার জুড়ে গেল সেই তালিকায়। বারাণসী-সহ আশপাশের ছ’টি জেলার কমিশনার এস এম শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘বারাণসীর জলে আর্সেনিকের বিষ রয়েছে। স্বীকার করতে বাধা নেই, আমাদের রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এই পরীক্ষা চালিয়ে ভূগর্ভের জলে অতিমাত্রায় আর্সেনিকের প্রমাণ পেয়েছে।’’
১৭ লক্ষ জনসংখ্যার বারাণসী শহরে জল সরবরাহ হয় কী ভাবে?
কমিশনার জানান, প্রতিদিন সরকারি স্তরে ১২ কোটি ৩০ লক্ষ লিটার জল নেওয়া হয় গঙ্গা থেকে। আর ১৪ কোটি ৩০ লক্ষ লিটার জল নেওয়া হয় মাটির তলা থেকে। এ ছাড়া বেসরকারি ভাবে ভূগর্ভ থেকে তোলা হয় আরও ছ’কোটি ৭০ লক্ষ লিটার জল। শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘বেসরকারি ভাবে তোলা জল শোধনের দায় সরকারের নয়। বাকি ২৬ কোটি ৬০ লক্ষ লিটার জল পরিশোধন করা হয় তিনটি কেন্দ্রে।’’
কেমন হাল সেই পরিশোধনের?
সরকারি আধিকারিক জানাচ্ছেন, বারাণসীর ১২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম দীনাপুরে ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’ (গ্যাপ)-এর কাজ চলাকালীন প্রথম জল শোধন কেন্দ্র গড়া হয়। প্রায় দু’হাজার পরিবারের ওই গ্রামে ফুল ফোটে অনেক। কোনও ফসল ফলে না। কেন? চন্দ্রনাথ সিংহ নামে দীনাপুরের এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘শোধন কেন্দ্রের বর্জ্য গ্রামের কৃষিজমিতে ছড়িয়ে দেওয়ার পরে প্রথম বছর ভাল ফসল হয়েছিল। কিন্তু তার পরের বছর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। ধান, গম, সব্জি চাষ করলে তাতে বিকট গন্ধ হত। হাটে নিয়ে গেলে একটি দানাও বিকোত না।’’ তার পর থেকেই গ্রামের কিছু জমিতে শুরু হয় ফুলের চাষ। কিন্তু সেই ফুলও শুকিয়ে গেলেই রাসায়নিকের উত্কট গন্ধ বেরোয়।
কেন এমন হয়? বারাণসী আইআইটি-র এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক প্রভাত সিংহ বলেন, ‘‘বারাণসী শহরের ভূগর্ভের জলে আর্সেনিক রয়েছে বিপজ্জনক মাত্রায়। কিন্তু জল শোধন কেন্দ্রে আর্সেনিক দূরীকরণের কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে জল শোধন করে জমিতে বর্জ্যের সঙ্গে আর্সেনিকের বিষ ফেলা হচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে। সেই বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। ফসলও দূষিত হয়ে গিয়েছে।’’
১৯৮৬-র ১৪ জুন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে গ্যাপ-এর সূচনা করেন। সেই প্রকল্পে ‘আশানুরূপ’ কাজ হয়নি। তার পরে মোদী সরকার শুরু করে ‘গঙ্গা রিজুভিনেশন’ কর্মসূচি। নতুন প্রকল্পের মূল খরচ ধরা হয়েছে ছ’হাজার কোটি টাকা।
কী কাজ হচ্ছে সেই টাকায়?
এপ্রিলেই বারাণসীতে সফরে যান জাহাজমন্ত্রী নিতিন গডকড়ি। তিনি জানান, গঙ্গা সাফাই অভিযানের জন্য সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে চার হাজার কোটি টাকা পেয়েছে কেন্দ্র। সেই টাকায় সাফাই অভিযান ছাড়াও বারাণসী থেকে হুগলি পর্যন্ত গঙ্গার উপরে ১০০ কিলোমিটার অন্তর বাঁধ দিয়ে সেতু তৈরির প্রস্তাব বিবেচনা করছে কেন্দ্র। এ ছাড়া স্বচ্ছ গঙ্গার উপরে জল-পর্যটনের জন্য তাঁর মন্ত্রক স্টিমার, ছোট জাহাজ চালানোর পরিকল্পনা করেছে বলে জানান মন্ত্রী।
কেন্দ্রের এই পরিকল্পনার কথা মন্ত্রীর কাছে শুনেই প্রতিবাদ জানান স্থানীয় পরিবেশবিদ ও বারাণসী আইআইটি-র ইলেক্ট্রনিক্স অধ্যাপক বিশ্বম্ভর নাথ মিশ্র-সহ কয়েক জন। মিশ্র পরে বলেন, ‘‘কেন্দ্র যা করতে চাইছে, তাতে স্রোতস্বিনী গঙ্গা ১০০টি পুকুরে পরিণত হবে।’’ তিনি জানান, বরুণা ও আসী নামে দু’টি শাখানদী থেকেই বারাণসীর নামকরণ। আসী নদী মলমূত্র ও বর্জ্যের ধারক হয়ে মজে গিয়েছে। প্রায় একই হাল বরুণার।
গঙ্গা বারাণসী ও বাংলার যোগসূত্র। ওই নদী শোধনের কাজ এ রাজ্যেও যে খুব এগিয়েছে, তা নয়। এই অবস্থায় আর্সেনিকের বিষ থেকে বাংলা ও বারাণসীর মুক্তি দূর অস্ত্।