ব্যাঙ্কশাল কোর্ট চত্বরে মানিক ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র।
মঙ্গলবার গ্রহণের বিকেল।
প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের পহেলা বাইশ ওয়ার্ডের দু’নম্বর সেলের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে ‘পার্থদা’ বলে ডাক দেন তিনি। সাড়া আসেনি বন্ধ কুঠুরির ওপার থেকে। পিঠে হাত দিয়ে মানিক ভট্টাচার্যকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন জেলকর্মীরা।
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য গত ১৪ দিন ধরে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-র হেফাজতে ছিলেন। সেই হেফাজতের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরে এ দিন তাঁকে কলকাতার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক শ্রীপর্ণা রাউতের এজলাসে তোলা হয়। বিচারক তাঁকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
আদালত থেকেই প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয় মানিককে। জেল সূত্রের খবর, অফিসঘরে নিয়ে যাওয়ার পথেই বাঁ দিকে পড়ে পহেলা বাইশ ওয়ার্ডের দু’নম্বর সেল। স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) দুর্নীতি কাণ্ডে সিবিআই ও ইডির মামলায় সেখানে রয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সে কথা জানতে পেরে অফিস ঘরে যাওয়ার পথে ওই সেলের সামনেই থমকে দাঁড়ান মানিক। ওই ওয়ার্ডেই তাঁকে রাখা হয়েছে।
এ দিন আদালতে ইডির আইনজীবীরা জানান, মানিকের পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা নানা সংস্থায় ও যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় ১০ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে। মানিকের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় তিন কোটি টাকা রয়েছে। মানিক দুর্নীতিতে সরাসরি যুক্ত। হেফাজতে থাকাকালীন জিজ্ঞাসাবাদে অসহযোগিতা করেছেন এবং তদন্তকে অন্য পথে চালিত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁকে সংশোধনাগারে গিয়েও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে। আদালতে ইডির তরফে এ-ও জানানো হয়েছে, জীবিত নন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যাঙ্কের যৌথ অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত লেনদেন করেছিলেন মানিক ও তাঁর আত্মীয়রা। পরে ইডি সূত্রের দাবি, ওই সব অ্যাকাউন্টের লেনদেনে তারা বেশ কিছু বেনিয়ম পেয়েছে, যা পরে আদালতে জানানো হবে।
ইডি-র অভিযোগ, মানিকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একাধিক ব্যক্তির যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, অ্যাকাউন্ট খোলার বছর খানেক পরেই মারা গিয়েছেন যৌথ অ্যাকাউন্টের অংশীদার দ্বিতীয় ব্যক্তি। সেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলি সক্রিয় এবং সেগুলিতে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ব্যাঙ্ককে জানানো হয়নি যে ওই সব যৌথ অ্যাকাউন্টের অন্যতম অংশীদার মারা গিয়েছেন।
ওই প্রসঙ্গে তদন্তকারী অফিসার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের উল্লেখ করে মঙ্গলবার আদালতে জানান, ২০১৬ সালে মানিক ভট্টাচার্যের স্ত্রীর সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তির যৌথ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। কিন্তু অ্যাকাউন্ট খোলার কয়েক মাস পরেই ওই ব্যক্তি মারা যান। ওই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
তবে ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, প্রথমত পরিবারের বাইরে কারও সঙ্গে যৌথ অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা নেই। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে দেখানো যেতে পারে। যার প্রমাণপত্র ব্যাঙ্ক চায়ও না। দ্বিতীয়ত, যৌথ অ্যাকাউন্টে (আইদার অর সারভাইভার নিয়মে অর্থাৎ জীবিত যে কোনও এক জন সেই অ্যাকাউন্ট চালু রাখতে পারেন) নাম থাকা একজন মারা গেলে দ্বিতীয় জন সেই অ্যাকাউন্ট চালু রাখতে পারেন।
সে ক্ষেত্রে প্রথম ব্যক্তির মৃত্যুর খবর ব্যাঙ্ককে জানানো বাধ্যতামূলক নয়। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের দাবি, মৃত্যুর নথি দিলে ভাল। না দিলে সেটা বেআইনি নয়। আর দ্বিতীয় ব্যক্তির মৃত্যুর পরে প্রথম ব্যক্তি অনায়াসে সেই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে যেতে পারেন। সেটাও বেআইনি নয়। শুধু, প্রয়াত ব্যক্তির নামে কোনও চেক সেই অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে না। সে রকম হলে তা বেআইনি। ইডি সূত্রের দাবি, তারা ওই সব অ্যাকাউন্টের লেনদেনে বেনিয়ম কিছু পেয়েছে। কী সেই বেনিয়ম, তা তারা পরবর্তী শুনানির দিন আদালতে জানাবে।
তবে এ দিন আর মানিককে নিজেদের হেফাজতে রাখার আবেদন করেনি ইডি। উল্টে ইডির আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি ও অভিজিৎ ভদ্র মানিককে জেল হেফাজতে পাঠানোর আবেদন করেন। মানিকের আইনজীবী সঞ্জয় দাশগুপ্ত জামিনের আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘‘মানিকের জেল হেফাজতের আবেদন করেছে তদন্তকারী সংস্থা। সে ক্ষেত্রে তো জিজ্ঞাসাবাদের আর প্রয়োজন নেই! ফলে তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হোক।" দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে ভারপ্রাপ্ত বিচারক ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মানিককে জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ওই দিন সিবিআই বিশেষ আদালত (পিএমএলএ)-এ মানিককে হাজির করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
তদন্তকারী অফিসারের দাবি, মানিকের ছেলে সৌভিকের একটি পরিষেবামূলক সংস্থার হদিস পাওয়া গিয়েছিল। ওই সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। রাজ্যের প্রায় ৫৫০টি বেসরকারি বিএড কলেজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সৌভিকের ওই সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়েছিল।
তদন্তকারী অফিসারের দাবি, হেফাজতে থাকাকালীন মানিককে জিজ্ঞাসাবাদে মেসার্স এডুক্লাস নামে সৌভিকের আর একটি সংস্থার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এবং ওই সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা জমা পড়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ওই টাকা সৌভিকের সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে।
প্রসঙ্গত, বেসরকারি বিএড কলেজগুলির মালিকদের নিয়ে মানিকই বকলমে ওই সংগঠন তৈরি করেছেন বলে ইডির তদন্তকারীদের দাবি। অভিযোগ, অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতিও মানিক ঘনিষ্ঠ। তদন্তকারী অফিসারের দাবি, প্রাথমিকে সরকারি চাকরি বিক্রির দুর্নীতিতে ঘনিষ্ঠদের মারফত বহু বেসরকারি বিএড এবং ডিইএলইডি কলেজ জড়িত রয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।