অর্জুন সিংহ, দ্লীপ ঘোষ এবং সব্যসাচী দত্ত। —ফাইল চিত্র
ভোটে বিপর্যস্ত সংগঠন মেরামতির বৈঠক ডেকেছিলেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ। কিন্তু মঙ্গলবারের বৈঠকে মেরামতির সুযোগই মেলেনি বলে দলীয় সূত্রেই খবর। তার বদলে ক্ষোভ-বিক্ষোভে দলের ‘ছন্নছাড়া’ ছবিই ফুটে ওঠে। বৈঠকে বিধানসভা নির্বাচনে দলের নীতি নিয়ে উঁচু গলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহ। তাঁর বক্তব্য ছিল, স্থানীয় নেতৃত্বকে কাজই করতে দেওয়া হয়নি। উল্টে বাইরে থাকা আসা বাংলার রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞরা ভোটে হারিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। ভোটের প্রচারে বাঙালি মুখ না থাকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন বিধাননগরের প্রার্থী সব্যসাচী দত্ত। একটা সময় তাঁকে থামিয়েও দেন দিলীপ। সময়ের অভাব দেখিয়ে বক্তব্য শেষ করতে বলেন রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তীও। মঙ্গলবারের বৈঠকে ‘আত্মসমালোচনা’-র মোড়কে যাঁরা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বেশি গলা চড়িয়েছেন তাঁদের নামেও বড় মিল। মহাভারতের চরিত্র অর্জুন-ই তো সব্যসাচী যাঁর দু’হাত সমান চলে। আর সেই কারণেই সব্যসাচীই অর্জুন।
মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময়সীমার মধ্যে বৈঠক শেষ করা যায়নি। আরও ৪০ মিনিট টেনে নিয়ে যেতে হয়। বিধানসভা ভোটের হারের কারণ বর্ণনা করতে অনেকেই এত বেশি সময় নিয়ে সাংগঠনিক ত্রুটি তুলে ধরতে শুরু করেন যে কেউ কেউ বলার সুযোগই পাননি। দলের সহ সভাপতি ভারতী ঘোষ থেকে বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকাররা সে ভাবে বলার সুযোগই পাননি। ওই বৈঠকে উপস্থিত এক বিজেপি-নেতার কথা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি সরব হন অর্জুন। তাঁর বক্তব্য ছিল, রাজ্য বিজেপি-র দায়িত্বপ্রাপ্তরা সাংসদদের সংগঠনের থেকে আলাদা করে রেখেছেন। বেশির ভাগ সিদ্ধান্তেই তাঁদের মতামত নেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর লোকসভা এলাকায় কী কী হয়েছে সেটাও তিনি অনেক সময় জানতেই পারেননি। অর্জুনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ভোটের কাজে ভিন্ রাজ্য থেকে আসা নেতারাও। তিনি নাকি এমনটাও বলেন যে, কেউ চেনেই না এমন নেতাদের বাংলায় এনে কোনও লাভ হয়নি। বিভিন্ন রাজ্যের অখ্যাত মন্ত্রী, নেতাদের বিভিন্ন বিধানসভার দায়িত্ব দেওয়াটা ভুল হয়েছিল বলেও সরব হন অর্জুন।
প্রায় একই সুরে আক্রমণ শানান সব্যসাচীও। তবে তিনি সবটা বলতে পারেননি। নেতৃত্বের বাধায় থেমে যেতে হয় তাঁকে। সব্যসাচীর বক্তব্য ছিল, এক দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় মুখ থাকলেও তাঁরা বিপরীতে কোনও বাঙালি মুখ না রাখাটাই পতনের কারণ। ভোটে হারের জন্য কারও নাম না করলেও হিন্দিভাষী নেতাদের দিকে আঙুল তোলেন তিনি। সরব হয়েছিলেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ-ও। তিনি অবশ্য মূলত সাংগঠনিক ত্রুটি নিয়েই কথা বলেন। অন্য দিকে, হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় সরব হন দলের মধ্যেই এক শ্রেণির নেতার কাজকর্ম নিয়ে। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা জানিয়েছেন, মূলত হুগলি জেলায় অনেক নেতা তোলাবাজির সিন্ডিকেট চালাচ্ছে বলে দলীয় বৈঠকে সরব হন লকেট। বিজেপি সূত্রের দাবি, সাংগঠনিক ত্রুটি এবং এলাকার সাংসদকে ভোটের কাজে সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে সরব হন বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদারও। তবে বৈঠক সঞ্চালনার দায়িত্বে থাকা পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় মাহাতো কোনও ক্ষোভ প্রকাশ করেননি।
উল্লেখ্য, নিজেদের ক্ষোভ জানাতে মঙ্গলবার যাঁরা বেশি সরব হয়েছে তাঁদের মধ্যে ৪ জনই সাংসদ। এঁদের মধ্যে আবার দু’জন অর্জুন, সৌমিত্র এবং মঙ্গলবারের বৈঠকে ডাক না পাওয়া কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক বুধবার সকালেই রাজ্য নেতৃত্বকে অন্ধকারে রেখে দিল্লি গিয়েছেন। বাংলা থেকে জয়ী এক বিজেপি সাংসদের বক্তব্য, ‘‘এই রাজ্যের ১৮ জন সাংসদের মধ্যে ২ জন মন্ত্রী। তাঁরা বেশির ভাগ সময় দিল্লিতেই কাটান। আর বাকি ১৬ জনের মধ্যে ১৫ জনই সংগঠনে উপেক্ষিত। একমাত্র সাংসদ দিলীপ ঘোষ যে হেতু রাজ্য সভাপতি তাই তিনি একাই সংগঠনের সব দেখেন।’’ দিলীপ ঘনিষ্ঠ এক নেতার বক্তব্য, ‘‘নির্বাচন পর্বে দিলীপদার কথাও সে ভাবে শোনা হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতারাই সব করেছেন। ওঁকে টার্গেট করার কোনও মানে হয় না। আর দলের খারাপ ফলের দায় দিলীপদার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা সেটাও ঠিক নয়। রাজ্য সভাপতিকে না জানিয়ে যাঁরা সরাসরি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তাঁরা ভালর কৃতিত্ব নিলেও যাবতীয় খারাপের জন্য দিলীপদার দিকে আঙুল তোলেন।’’ মঙ্গলবারের বৈঠকে বেশি সরব হওয়াদের বেশির ভাগই তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে আসা বলেও দাবি করেন ওই নেতা।