লিউ আহমেদের গায়ে সুফিয়ানের তৈরি লোহার বর্ম। (বাঁ দিকে) ধৃত আবু সুফিয়ানের ঘরে হদিশ গোপন কুঠুরির। —নিজস্ব চিত্র
বাড়ির মেঝের তলায় গোপন কুঠুরি। পাতলা লোহার পাত দিয়ে তৈরি বর্ম। মাদ্রাসা তৈরির জন্য তোলা চাঁদার মোটা অঙ্ক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে…
কেরল এবং এ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ থেকে দুই কলেজ পড়ুয়া-সহ ৯ জনকে আল-কায়দা যোগে গ্রেফতারের পর, জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ-র গোয়েন্দাদের দাবি— ‘‘অনেক দূর এগিয়েছিল এই মডিউল।” তাঁদের আরও দাবি, শুধুমাত্র অনলাইনেই বিভিন্ন জেহাদি চ্যাট গ্রুপে যোগাযোগ রেখে এই মডিউল নাশকতার পথে যতটা এগিয়েছিল, তা আশঙ্কা জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট।
শনিবার ভোরে এই ৯ জনকে গ্রেফতারের পর, এনআইএ হেফাজতে ধৃতদের জেরা করেন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ আধিকারিকরা। তার মধ্যে রাজ্য পুলিশের বিভিন্ন শাখার আধিকারিকরাও রয়েছেন। ছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (আইবি)-র আধিকারিকরাও।
ধৃতদের জেরা করে ওই আধিকারিকদের ইঙ্গিত— ধৃতেরা ‘সালাফি’ হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। সাধারণ ভাবে সালাফিরা সুন্নি সম্প্রদায়ের একটি অংশ যাঁরা বিশ্ব জুড়ে ইসলামের শাসন কায়েম করতে চান। ইসলামপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোতে নিয়ম হল— মুজাহিদ হতে গেলে আগে সালাফি হতেই হবে। তদন্তকারীদের মতে, অনলাইনে জেহাদি প্রচার পুস্তিকা, বিভিন্ন বই, ওসামা বিন লাদেন সহ আল কায়দার শীর্ষ নেতাদের দেওয়া ভাষণের অডিও শুনেই এই দলটি সালাফি হওয়ার দিকে এগোচ্ছিল।
আরও পড়ুন: পথ আটকে চিনা ফৌজ, দেপসাংয়ে ব্যাহত টহলদারি
তদন্তকারীদের দাবি, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী জামাতুল মুজাহিদিন (বাংলাদেশ) বা জেএমবি-র ভারতীয়করণের পর ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে জেহাদি পত্রপত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করে ওই সংগঠন। ধৃতরাও সেই ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ গ্রুপের সদস্য। ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ শব্দের অর্থ সামরিক শক্তি দিয়ে ভারত জয়। অর্থাৎ সশস্ত্র জেহাদ।
এনআইএ তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, ওই গ্রুপে অনলাইনেই ধৃতরা জেহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য ‘দাওয়াত’ দেন এবং নিজেরা ‘দ্বীন’ হয়েছেন। নতুন কাউকে সংগঠনে মুজাহিদ হিসাবে গ্রহণ করার জন্য এটি আল কায়দার একটি সাংগঠনিক পদ্ধতি।
এ ধরনের গ্রুপের সদস্য ছিল ধৃতরা। অনলাইন গ্রুপেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল উল্ফ প্যাক তৈরি করার। —সংগৃহীত
তদন্তকারীদের দাবি, ওই গ্রুপ এবং ‘কিতল ফর ইসলাম’ নামে অন্য একটি গ্রুপে বাংলায় জেহাদি প্রকাশনা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সদস্যদের ‘উল্ফ প্যাক’ তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ‘উল্ফ প্যাক’-এর ধারণাটি অনেকটাই ‘লোন উল্ফ’-এর মতো। অর্থাৎ সরাসরি আল কায়দা সংগঠনের কাছ থেকে কোনও আর্থিক বা অন্য কোনও সহায়তা না নিয়ে একটি মডিউল তৈরি করে আল কায়দা মতাদর্শে কোনও নাশকতা ঘটানো। তদন্তকারাদের দাবি, জেরায় ধৃতরা স্বীকার করেছেন যে, ওই গ্রুপগুলির যাঁরা অ্যাডমিন তাঁরা তাঁদের ‘উল্ফ প্যাক’ তৈরি করতে নির্দেশ দেন এবং সেই পরামর্শ মতোই তাঁরা ওই মডিউলটি তৈরি করেন।
আরও পড়ুন: তুমুল অশান্তির মধ্যেই রাজ্যসভায় পাশ জোড়া কৃষি বিল
ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়ার সূত্রে এবং কাছাকাছি এলাকায় থাকার সূত্রে ধৃতেরা প্রত্যেকেই পূর্ব পরিচিত। এবং সেই যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ৮ মাস আগে থেকে এরা পরিকল্পনা করে ‘বড়’ কিছু ঘটানোর, যাতে গোটা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, সেই পরিকল্পনা তাঁরা গ্রুপ অ্যাডমিনকেও জানায়। ‘হামজা’ নামে ওই গ্রুপ অ্যাডমিন তাঁদের উৎসাহ জোগায় এবং মাদ্রাসা ও ধর্মীয় মেহফিল করার নাম করে তহবিল তৈরির নির্দেশ দেয়। সেই মতোই এরা একটি তহবিল তৈরি করা শুরু করে।
ধৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার বাজি, আইইডি তৈরির সরঞ্জাম, ধারাল অস্ত্র। ছবি -পিটিআই
ধৃতদের মধ্যে অন্যতম আবু সুফিয়ান নিজের বাড়িতে একটি লেদ কারখানা তৈরি করে, যাতে প্রয়োজন মতো যন্ত্রপাতি এবং ডিভাইস তৈরি করা যায়। এলাকায় দর্জি হিসাবে পরিচিত সুফিয়ান লোহার পাত দিয়ে তৈরি করে বর্ম। লিউ আহমেদকে পরিয়ে সেটার কার্যকারিতাও পরখ করে দেখা হয় বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। হামলার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি মজুত করার জন্য নিজের বাড়িতে একটি গোপন কুঠুরিও বানান সুফিয়ান। তদন্তকারীদের দাবি, সেখানে বাজার থেকে বিস্ফোরক এবং অস্ত্র কিনে মজুত করার পরিকল্পনা করেছিল সুফিয়ান।
গোয়েন্দাদের দাবি, গাজওয়াতুল হিন্দ গ্রুপেই আইইডি তৈরির কৌশল শিখে, তা বানানো শুরু করেছিল লিউ আহমেদ এবং সুফিয়ান। তবে সেটা আদৌ কতটা সফল হয়েছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে গোয়েন্দাদেরও। এনআইএ গোয়েন্দাদের দাবি, দিল্লিতে হামলার ছক করেছিল ধৃতরা। কিন্তু হামলার প্রয়োজনীয় অস্ত্র কোথা থেকে পেত ওই মডিউল, তা নিয়েও স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই গোয়েন্দাদের। একটি অংশের দাবি, পাক অধিকৃত কাশ্মীর থেকে কাশ্মীর হয়ে সেই অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ওই মডিউলের হ্যান্ডলার ‘হামজা’। কিন্তু এই তথ্য কতটা ঠিক, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে গোয়েন্দাদের মধ্যেও। কারণ, সাধারণত ‘উল্ফ প্যাক’-এর কোনও অপারেশনে মূল সংগঠন সরাসরি কোনও ধরনের সহায়তা করে না।
এনআইএ-র দাবি, বাজার থেকে চকোলেট বোমা বা বাজি কিনে মজুত করেছিল এরা। সেই বাজি থেকে বিস্ফোরক সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলক ভাবে আইইডি বানানোর পরিকল্পনা ছিল ওই মডিউলের। কিন্তু এনআইএ-র ওই দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অন্য একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা। তাঁদের দাবি, মুর্শিদাবাদের ডোমকলের মতো জায়গা যেখানে বোমার মশলা খুব সহজেই পাওয়া যায়, সেখানে বাজির মশলা দিয়ে আইইডি কেন বানাতে যাবে এরা?
শনিবার রাত থেকেই মুর্শিদাবাদ পুলিশের একটি দল, রাজ্য এবং কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের আধিকারিকরা, সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ‘জি’ ব্রাঞ্চের আধিকারিকরা ধৃতদের বেশ কয়েক দফা জেরা করেন। এনআইএ সূত্রে খবর, সোমবার ধৃতদের দিল্লি নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে পাটিয়ালা হাউজ কোর্টে পেশ করা হবে ধৃতদের।
উদ্ধার হওয়া দেশি আগ্নেয়াস্ত্র, লোহার বর্ম, বাজির মশলা এবং ধৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকদের অনুমান, ‘এই মডিউলটি খুব প্রাথমিক পর্যায়ে জেহাদের কাজ করছিল।” তাঁদের মতে এই মডিউলটিকে সরাসরি আল কায়দা মডিউল না বলে বড়জোর আল কায়দা মতাদর্শে অনুপ্রাণিত একটি মডিউল বলা যায়। কারণ গোয়েন্দাদের ধারণা, অনলাইনে ‘হামজা’ নামে যে হ্যান্ডল্যারের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, সে সম্ভবত পাকিস্তানে ঘাঁটি করে থাকা কোনও আল কায়দা সদস্য। সে হয়তো এ রকম একাধিক অনলাইন গ্রুপ চালায়। গোয়েন্দাদের একটি অংশের মতে, এরা হামলা চালানোর জন্য অস্ত্র বাংলাদেশ থেকে কেনার পরিকল্পনা করছিল, কারণ প্রত্যেকেই সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা। ধৃতদের কল রেকর্ডস থেকে সেই যোগাযোগগুলো খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
এই মডিউলটি কতটা সরাসরি আল কায়দার সঙ্গে যুক্ত তা নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও, রাজ্য পুলিশের আধিকারিক এবং কেন্দ্রীয় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা একটি ব্যাপারে চিন্তিত। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘অনলাইনে সালাফি হয়ে যদি এতটা দূর পর্যন্ত পরিকল্পনা করতে পারে খুব সাধারণ কয়েকজন মানুষ, তা হলে সেটা আশঙ্কার।” কারণ, একই ভাবে এ ধরনের জঙ্গি সংগঠনগুলো আরও এ ধরনের মডিউল সকলের অলক্ষ্যে তৈরি করতে পারে। তাদের মধ্যে কোনও একটি মডিউল মরিয়া চেষ্টা করে নাশকতাও ঘটাতে পারে। আনাড়ি ‘উল্ফ প্যাক’-কে রোখার রাস্তার হদিশ খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি।