এ বারের শিক্ষক দিবসের মঞ্চে খোদ শিক্ষামন্ত্রী যখন আশ্বাসটি দেন, আশার আলো দেখেছিলেন অনেক শিক্ষিকা। কিন্তু সংশয়ীরা সে-দিনই বলেছিলেন, মন্ত্রী কী ভাবে নিজের জেলায় শিক্ষিকাদের নিয়োগ ও বদলির আশ্বাস দিচ্ছেন, তা তিনিই জানেন। তবে কার্যক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা করা কার্যত অসম্ভব।
আইনি জট মোটামুটি কেটে যাওয়ার পরে স্কুলের সর্বস্তরে শিক্ষক নিয়োগের তোড়জোড় চলছে পুরোদমে। তাই নিজের জেলায় নিয়োগ তথা বদলির বিষয়টি আবার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। প্রার্থীরা, বিশেষত মহিলা প্রার্থীরা আশায় আশায় আছেন, শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী তাঁরা এ বার নিজের জেলায় বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে নিয়োগপত্র পেয়ে যাবেন। কিন্তু এই মোক্ষম সময়ে মন্ত্রীর ওই আশ্বাস রূপায়ণে অন্যদের সঙ্গে ঘোর সংশয় প্রকাশ করছে স্কুলশিক্ষা দফতরের একাংশও। তাদের বক্তব্য, বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ের শূন্য পদ এবং প্রার্থীদের চাহিদার অসামঞ্জস্যই এই আশ্বাস বাস্তবায়নের মূল বাধা।
অর্থাৎ?
শিক্ষা দফতরের কিছু কর্তার ব্যাখ্যা, কোন জেলায় শিক্ষকপদে কত মহিলা প্রার্থী আছেন, সেই খতিয়ানের ভিত্তিতে তো শূন্য পদের বন্দোবস্ত এবং নিয়োগের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। বরং খালি পদের সংখ্যা অনুসারে নিয়োগের ব্যবস্থা হয়। স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের পর্বে যে-জেলায় শূন্য পদ বেশি, মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সেখানেই বেশি প্রার্থী আবেদন করেন। এটাই স্বাভাবিক। কবে নিজের জেলায় নির্দিষ্ট বিষয়ের পদ শূন্য হবে, কোনও প্রার্থীই তার অপেক্ষায় বসে থাকবেন না। কারণ, চাকরির প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে নিজের জেলায় থাকার ইচ্ছে আঁকড়ে বসে থাকলে চলে না।
চাকরি পাওয়ার পরে দেখা যায়, হাওড়ার কোনও মহিলার নিয়োগ হয়েছে কাকদ্বীপের কোনও স্কুলে। কারণ, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বেশি পদ শূন্য জেনে ওই মহিলা সেখানেই আবেদন করেন। হাওড়ায় তাঁর বিষয়ে হয়তো কোনও পদই খালি নেই। বা যে-ক’টি পদ শূন্য আছে, মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। স্কুলশিক্ষা দফতরের এক কর্তা জানান, এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রীর নির্দেশ মেনে নতুন নিয়ম চালু করলে পুরো ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হতে পারে। বেশির ভাগ প্রার্থীর কাছেই চাকরিটা বেশি জরুরি। বাড়ির কাছে নিয়োগটা আসবে তার পরে। তাই নিয়োগপত্র হাতে পাওয়াটাই মুখ্য। যে-জেলায় ভূগোলের কোনও পদই খালি নেই, সেখানকার মহিলা প্রার্থী বাড়ির কাছে ওই পদে নিয়োগপত্র পাবেন কী করে?
তাই সম্প্রতি স্কুলশিক্ষা দফতর থেকে প্রকাশিত নিয়োগের গেজেটে নিজের জেলায় মহিলাদের নিয়োগের বিষয়ে একটি শব্দেরও উল্লেখ নেই। নজরুল মঞ্চে শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, দিনের বেশির ভাগ সময়টাই যদি যাতায়াতে চলে যায়, শিক্ষিকারা পড়ানোয় উৎসাহ পাবেন কী ভাবে? স্কুল-কলেজে ভাল পঠনপাঠনের জন্য শিক্ষিকাদের নিজেদের জেলাতেই নিয়োগ এবং বদলি প্রয়োজন। এখন মন্ত্রী জানাচ্ছেন, গেজেটে এই নিয়ে কোনও উল্লেখ থাকার কথাই নয়।
শিক্ষাকর্তাদের ব্যাখ্যা, ধরা যাক, হাওড়ায় ২০টি শূন্য পদ রয়েছে আর দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৩০টি। হাওড়ার কোনও প্রার্থী কাকদ্বীপের স্কুলে চাকরি পেলেন। কিন্তু তাঁকে হাওড়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে গেলে কাকদ্বীপে যে-শূন্য পদ তৈরি হবে, সেটি পূরণ করা সম্ভব হবে না। যদি না হাওড়া থেকেই কোনও প্রার্থী কাকদ্বীপে যেতে রাজি থাকেন। ‘মিউচুয়াল’ বা পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সেই বদলি সম্ভব। কিন্তু গেজেট প্রকাশ করে তা করা যায় না। আর মন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী যদি নিজের জেলা ছাড়া মহিলাদের বদলি করা না-যায়, সেটা সম্ভব করে তুলতে হলে বছরের পর বছর পেরিয়ে যাবে। কারণ, যথেষ্ট সংখ্যায় নির্দিষ্ট বিষয়ের পদ শূন্য না-হলে সেটা সম্ভব নয়।
কী বলছেন শিক্ষামন্ত্রী?
‘‘বদলির জন্য আলাদা করে নিয়মাবলি তৈরি হয়। শিক্ষিকারা আগে তো আবেদন করুন। তার পরে কোন জেলায় কোন বিষয়ের পদ খালি আছে, সেটা দেখে ভাবনাচিন্তা করা হবে,’’ বলছেন পার্থবাবু।
নিয়ম মেনে সেই বদলি যে কতখানি শিক্ষিকা-সহায়ক হবে, তা নিয়ে ধন্দে শিক্ষক সংগঠনগুলিও। বঙ্গীয় শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী সমিতির রাজ্য সহ-সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আইনের মধ্যে থেকে কার্যত তা করা অসম্ভব।’’
সংশোধনী এনে আইন পাল্টেও কি সেটা করা যায় না?
শিক্ষাজগৎ এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের একাংশ বলছেন, আইন বদলে নিজের জেলায় নিয়োগ ও বদলির ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা যায়। তবে সেটা হবে নিছক কাগজে-কলমেই। বাস্তবের সঙ্গে সেটাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা খুব কঠিন। কেননা, পদ খালি হওয়াটা সময়সাপেক্ষ। কবে নিজের জেলায় নিজের বিষয়ের পদ খালি হবে, তার জন্য কোনও প্রার্থী অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারেন না। আবার কাউকে এটাও বলা যায় না যে, নিজের জেলা ছাড়া অন্য জেলায় আবেদন করতে পারবেন না।