অলঙ্করণ: সনৎ সিংহ।
আরও একটি উদ্ভাসহীন বছর চলে গেল। বঙ্গজীবনে বিগত কয়েক বছরের মতো এ বারেও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম শুধু বিজ্ঞানসাধনায়। সেখানে বাঙালির জয়জয়কার। বাকি চর্বিতচর্বণ।
সাল-খাতা খুলে চলে যাওয়া বছরের হিসাব নেওয়ার সময় আজকাল মনে বিশেষ কোনও সাড়া জাগে না। সবই যেন গতানুগতিক লাগে। এমনকি, বছরভর যে সব ক্লেদ আমাদের দৈনন্দিনতাকে কলুষিত করে, তা থেকে উত্তরণেরও কোনও লক্ষণ কোথাও নেই। বরং দেখতে দেখতে, মানতে মানতে সেই কলুষ এখন ক্রমশই কেমন গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে। যেন এমনটাই হওয়ার ছিল, বা এ রকম তো কতই হয়!
তবু বছর পেরনোর দিনে পুরনো এবং নতুনের মাঝখানে দুলতে থাকা সাঁকোতে একটি বার দাঁড়াতেই হবে। প্রাচীনের কাছে আগামী তখন জানতে চাইবে, কী এনেছ? দেবে কী আমাকে? উত্তর আসবে, কিছু না, কিছু না। মুঠো ভরা ধুলো ও বালিতে। ২০২৩ সেই ধারায় কোনও ব্যতিক্রম নয়।
যেমন, গত বছর পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেলে গিয়ে খবর হয়েছিলেন। এ বার তালিকায় এলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। অর্থাৎ টাকার পাহাড় বানানোর অভিযোগে আরও এক মন্ত্রী জেল খাটছেন। এটুকুই যা সংযোজন! আর্থিক ও নিয়োগ সংক্রান্ত নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত শাসক-পোষিতদের সংখ্যাও এক বছরে অনেক বেড়েছে। আতশকাচের তলায় আরও এবং আরও নেতা ও তাঁদের পরিবার পরিজন। অন্য দিকে, প্রতিবাদী চাকরিপ্রার্থীদের ধর্না-আন্দোলন এই বছরেই পার করেছে হাজার দিন। অবশ্য এ সব নিয়ে নতুন করে কী বা বলার!
তবে ঘন আঁধার ভেদ করেও তো জ্যোৎস্না ছড়ায়। বিজ্ঞান চর্চায় বাঙালির এ বার সেই গৌরবের বছর। চুরি-জোচ্চুরি, অবিচার, অপশাসনকে এক দিকে ঠেলে দিয়ে এই বাঙালিই সেখানে মাথা তুলে বলতে পারে, তারা এই বছরে দুনিয়াকে তাক্ লাগিয়ে দেওয়া দুই মহাকাশ অভিযান ‘চন্দ্রযান-৩’ এবং ‘আদিত্য-এল১’-এর গর্বিত শরিক। অতঃপর কোনও অর্বাচীন যদি মুখ ফস্কে বলেও বসেন, চুরি থেকে চন্দ্রযান সবখানেই বাঙালি, তা হলে তাঁকে খুব দোষ দেওয়া যায় কি?
চেনা চাঁদের পিছন দিকটি কেমন, তা জানতে সেখানে সর্বপ্রথম নিরাপদে অবতরণ করে গবেষণার রসদ পাঠাতে সক্ষম হয়েছে ‘ইসরো’-তে তৈরি ভারতের ‘চন্দ্রযান-৩’। এখন সূর্যের পথে এগিয়ে চলেছে ‘আদিত্য-এল১’। দুই ক্ষেত্রেই যুক্ত হয়েছে এক ঝাঁক বাঙালির নাম।
চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযানের সফল অবতরণের পরে সেখান থেকে রোভার ‘প্রজ্ঞান’-এর পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণের নেতৃত্বে আমদাবাদে ইসরোর স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার-এর ডেপুটি ডিরেক্টর দেবজ্যোতি ধর। চন্দ্রযানের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র তৈরি করেছেন ইসরোর বিজ্ঞানী অনুজ নন্দী। এই যন্ত্র ভবিষ্যতে ভিন্গ্রহের প্রাণ সংক্রান্ত গবেষণাতেও নতুন দিশা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। চন্দ্রযান প্রকল্পেরই নানা বিভাগে যুক্ত ছিলেন আরও অনেক বাঙালি বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের কুর্নিশ।
সূর্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মহাকাশ-প্রকল্প ‘আদিত্য-এল১’-এর মধ্যেও অন্যতম ভূমিকা দুই বাঙালির। তাঁদের এক জন উত্তরাখণ্ডের আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব অবজ়ারভেশনাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য জন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্টিফিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী।
বিজ্ঞান সাধনায় দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারপ্রাপকদের গত বছরের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে এই বছর। তাতেও এগিয়ে বাঙালি। পদার্থবিদ্যায় পুরস্কৃত দু’জনেই বঙ্গসন্তান— বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি-র অনিন্দ্য দাস এবং মুম্বইয়ের টিআইএফআর-এর বাসুদেব দাশগুপ্ত। রসায়নে পুরস্কার জিতে নিয়েছেন মুম্বই আইআইটি-র দেবব্রত মাইতি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিজেতা কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির বিজ্ঞানী দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায়।
উল্লেখ থাক বাইপোলার ডিজ়অর্ডার সংক্রান্ত একটি নতুন গবেষণারও। বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এর সেই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শঙ্খনীল সাহা। আগামীর পথে এঁরা সবাই আমাদের প্রেরণা।
শিল্প, সাহিত্যে গলা বাড়িয়ে বলার মতো এই বছরেও কিছু নেই। প্রয়াত কন্নড় কবি কুভেম্পুর নামাঙ্কিত রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আরও এক বার বাঙালির মান বাড়ালেন। বাঙালির ঘরে এই পুরস্কার এ বারই প্রথম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের গান নিয়ে বিতর্ক এ বার সঙ্গীতক্ষেত্রে আলোচনার একমাত্র উপকরণ। এ বছরেই রাজ্যের সঙ্গীত হিসাবে সরকারি ভাবে বেছে নেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি। সেই জন্য বৈঠক ডেকে আলোচনান্তে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, গানের বাণী বদল করা হবে না। অথচ চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে সেই গানেরই বাণী বদল করে বিশিষ্ট শিল্পীরা গেয়েছেন ‘বাংলার (বাঙালির নয়) ঘরে যত ভাইবোন।’ কেন? উত্তর মেলেনি এখনও। তবে বিতর্ক তুঙ্গে।
একই ভাবে কাজী নজরুলের ‘কারার ওই লৌহকপাট’ গানটির সুরবিকৃতির অভিযোগে বিদ্ধ সুরকার এ আর রহমান। একটি ওটিটি-তে প্রদর্শিত হিন্দি ছবিতে গানটি ব্যবহার করা হয়। যা শুনে ক্ষোভ ছড়ায় এ-পার, ও-পার দুই বাংলাতেই। গানটি অবশ্য বহাল তবিয়তেই আছে।
কিছু কিছু বাংলা ছবি ইদানীং দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে টেনে নিয়ে যেতে পারে। ‘দশম অবতার’, ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ও ‘রক্তবীজ’ এই বছরের তেমনই তিনটি ছবি। বহু বছর পরে এ বার বাংলা ছবি করছেন শর্মিলা ঠাকুর। শুটিং শুরু হয়ে গিয়েছে। শর্মিষ্ঠা মাইতি ও রাজদীপ পাল পরিচালিত বাংলা ছবি ‘কালকক্ষ’ এ বছর জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত।
সীমান্তের অনুষঙ্গে ‘গরুপাচার’ এখন বঙ্গজীবনে সবচেয়ে পরিচিত শব্দ। যার গ্রাসে বাংলার রাজনীতিও। সেই সীমান্তেই ১৯৭১-এর পটভূমিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জোছনাকুমারী’ বলেছে এক নারীর নির্যাতিত হওয়ার কাহিনী। এই বছর মঞ্চে এটি এক উল্লেখযোগ্য উপস্থাপন। প্রসঙ্গত, নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়িকে নিয়ে এ বারেই প্রকাশিত হয়েছে ব্রাত্য বসুর সুখপাঠ্য উপন্যাস ‘দ্যূতক্রীড়ক’।
ক্রীড়াক্ষেত্রে বঙ্গতনয়াদের সাফল্য এ বার তুলনায় বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনূর্ধ্ব ১৯-এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে সাত উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারত। নেপথ্যে বাংলার তিন কন্যা— তিতাস সাধু, রিচা ঘোষ ও ঋষিতা বসু। চার ওভারে মাত্র ছ’রান দিয়ে দু’টি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন তিতাস। এশিয়ান গেমসে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সোনাজয়ী ভারতের দলেও ছিলেন বাংলার রিচা ওদীপ্তি শর্মা।
২০২৩-এর হ্যাংঝাউ এশিয়ান গেমস-এ মেয়েদের টেবল টেনিসে ব্রোঞ্জ জিতেছেন ঐহিকা ও সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়। আজ়ারবাইজানে শুটিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে দলগত বিভাগে সোনাজয়ী বাংলার মেহুলি ঘোষ। ব্যক্তিগত বিভাগে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। আর এশিয়ান গেমসে দলগত বিভাগে দেশকে এনে দিয়েছেন রুপো।
মোহনবাগান সমর্থকদের জন্য ২০২৩ ছিল খুশির বছর। ২৩ বছর পরে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে তারা ডুরান্ড জয়ী। এ বারই বেঙ্গালুরু এফসি-কে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথম আইএসএল চ্যাম্পিয়নও এটিকে-মোহনবাগান। তবে মোহনবাগানকে হারিয়ে কলকাতা লিগ এ বার মহমেডানের।
মাঠ-ময়দান কি রাজনীতি ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে! এ বার বঙ্গ-রাজনীতি নানা দিক থেকে জমজমাট। নতুন বছরে পা দিয়েই দেশে ভোটের দামামা বাজবে। জোট রাজনীতিতে বাংলা কী অবস্থান নেবে, এখানে বিরোধী জোট দানা বাঁধবে কি না, কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের আসন রফার কী হবে, ২০২৩-এর শেষ সূর্য এ সব না জানিয়েই অস্তগামী।
বছর শেষে রাজ্য বিজেপির নড়বড়ে অবস্থাও বেশ প্রকট। প্রধান বিরোধী দলটির পক্ষে যা আদৌ স্বস্তিজনক হতে পারে না। পাশাপাশি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে তৃণমূলেআদি-নব্য টানাপড়েন। সেখানেও পরিস্থিতি অস্পষ্ট।
বস্তত এত দিন বিষয়টি ছিল গুঞ্জনে। ২০২৩ তাকে টেনে নিয়ে এল প্রকাশ্যে—রাজনীতির গম্ভীর আলোচনা থেকে চায়ের দোকানের রসালো মজলিশ পর্যন্ত। সৌজন্যে তৃণমূলেরই মুখপাত্র! যিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলে জানতে চাইলেন, নতুন প্রজন্ম আর কতকাল ‘না-পেয়ে’ থাকবে? কে না জানে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন নব-প্রজন্মের অবিসংবাদী ‘মুখ’।
অন্য দিকে বছরের শেষ জনসভায় দাঁড়িয়ে মমতার কড়া বক্তব্য, ‘‘দলে প্রবীণদের মর্যাদা দিতে হবে। পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। বড় হয়েছি বলে কাউকে পাত্তা দেব না, তা হতে পারে না।’’ বাকিটুকু তোলা থাক নতুন বছরের জন্য।
‘নয়া অবতার’-এ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এই বছরের অন্য এক চমক! ‘দিদি’-র রাজ্যে ‘দাদা’কে নিয়ে বার বার নানা রকম রাজনৈতিক জল্পনা ছড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে তার কিছু মিলিয়ে গিয়েছে, কিছু সংশয় হয়তো ধামাচাপা পড়ে রয়েছে। গত বছর ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড থেকে সৌরভকে ‘সরিয়ে’ দেওয়ার সময় ‘দাদা’র পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ‘দিদি’ মমতা। এই বার ‘দাদা’ একদম সরাসরি নেমে পড়লেন ‘দিদি’র মাঠে। স্পেনে মুখ্যমন্ত্রীর শিল্প সফরের সঙ্গী হয়ে সৌরভকে সহসা ‘আত্মপ্রকাশ’ করতে দেখা গেল একটি সংস্থার পক্ষে ইস্পাত কারখানার ঘোষণা নিয়ে। শুধু তা-ই নয়, শাহরুখ খানকে সরিয়ে কিছু দিন আগেই রাজ্যের নতুন ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ করা হয়েছে তাঁকে। নতুন বছরে কি তাঁর আরও কোনও ‘প্রাপ্তিযোগ’, প্রশ্ন হাওয়ায় ভাসছে।
প্রয়াণ জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তবু বর্ষবিদায়ের কালে পিছনে তাকিয়ে স্মৃতিভার সর্বদাই পীড়িত করে। ফেলে আসা বছরে প্রয়াণের তালিকাটি দীর্ঘ। বছরের শেষ প্রান্তে প্রয়াত হলেন নবতিপর প্রবীণ সন্ন্যাসিনী, রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের সাধারণ সম্পাদক প্রব্রাজিকা অমলপ্রাণা। ২০২৩-এ বিদায় নিয়েছেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ, লেখক সমরেশ মজুমদার, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গীতশিল্পী সুমিত্রা সেন, অনুপ ঘোষাল, কল্যাণী কাজী, চিত্র ও নাট্য পরিচালক গৌতম হালদার, চিত্র পরিচালক প্রদীপ সরকার, ফুটবলার পরিমল দে, শ্যামল ঘোষ প্রমুখ। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে সমাজ ও সময় কোনও না কোনও ভাবে ঋণী।
এমন করেই বছর যায়, বছর আসে। চলা শুধু অন্তহীন। ভাল এবং আরও ভাল কিছু প্রাপ্তির জন্য প্রত্যাশাও তাই থেকেই যায়। মন বলে, এ বার যা হল না, আগামী বছর তা নিশ্চয় হবে! নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই বিশ্বাসটুকুই শেষ পর্যন্ত আমাদের সঞ্জীবনী শক্তি। এগিয়ে চলার প্রেরণা।
স্বাগত ২০২৪।