এই আবেদন শুনে রশিদি বলেন, ‘‘আনিসের বাবা শুধু ইনসাফ (বিচার) চেয়েছেন৷ সেটা দাবি করা তাঁর অধিকার। কিন্তু সবার উপরে শান্তিটা বজায় রাখতেই হবে৷ আমার মনে হয়, আনিসের বাবাও সে কথাই বলতে চেয়েছেন।’’
আমতা থানা চত্বরে জনতাকে শান্ত করছেন আনিস খানের বাবা সালেম খান। নিজস্ব চিত্র
তখন বৃষ্টির মতো পুলিশের দিকে ইট ছুডছে বিক্ষোভকারীরা। ভেঙে ফেলা হয়েছে বাঁশের ব্যারিকেড। ফেলে দেওয়া হয়েছে গার্ডরেল। ঢাল তুলে কোনও রকমে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। একই সঙ্গে চেষ্টা চলছে থানা আগলানোরও।
শেষমেশ ইট থেকে বাঁচতে পুলিশও পাল্টা রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নেয়। ভয়ে স্থানীয় লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেন। তখনই মাইকে শোনা গেল পুত্র-হারানো এক বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর, ‘‘আমি আনিসের আব্বা বলছি। আমরা এখানে পুলিশ মারতে আসিনি। যারা ঢিল ছুড়ছে তারা তৃণমূলের দালাল। তারা আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে, তাদের দালাল। এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে ভণ্ডুল করতেই ভিড়ের মধ্যে থেকে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ছে। আপনারা শান্ত হোন। যারা ঢিল ছুড়ছে, তাদের চিহ্নিত করে বাধা দিন। পুলিশকে লক্ষ্য করে কেউ ইট ছুড়বেন না।’’
সুরটা চেনা লাগছে?
চার বছর আগে, মার্চ মাসের একদিন এমনই আবেদন শোনা গিয়েছিল আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম ইমদাদুল্লাহ রশিদির কণ্ঠেও। গোলমালে তেতে থাকা ওই শহরে ইমামের কিশোর পুত্র নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। পরে তার দেহ মেলে।
শেষকৃত্যের সময়ে ছেলের দেহের সামনে দাঁড়িয়ে উপস্থিত লোকজনকে রশিদি বলেছিলেন, ‘‘কেন এই মৃত্যু, আমি জানতে চাই না। তোমরা যদি আমায় ভালবাস, তবে এই মৃত্যু নিয়ে হইচই কোরো না। সবাই শান্তি বজায় রাখো। শহরে আগে শান্তি ফিরুক।’’
তার পরে ধীরে ধীরে শান্তি ফেরে আসানসোলে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনও রকম হিংসা থেকে সবাইকে নিবৃত্ত করতে সে দিন ওই ইমামের আবেদনে চমকে গিয়েছিলেন সকলে। আনিস হত্য-মামলায় গ্রামবাসীর রোষ পুলিশের বিরুদ্ধেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে, বৃহস্পতিবার দুপুরে আমতা থানার সামনে সালেমের ওই আবেদনের পরে শান্ত হয় উন্মত্ত জনতা।
এ দিন গ্রামবাসী, ফুরফুরা শরিফের একাধিক পিরজাদা, তাঁদের বহু ভক্ত, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা, আমতা কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আমতা থানার সামনে ওসি-কে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছিলেন। শামিল হয়েছিলেন সালেমও। কিন্তু সেই বিক্ষোভ থেকে যে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা এবং ধুন্ধুমার হবে, তা ভাবতে পারেননি আনিসের বাবা।
পিরজাদা কাশেম সিদ্দিকী যখন বিশৃঙ্খলা না করার আবেদন করে ব্যর্থ হন, তখনই মাইক হাতে তুলে নেন সালেম। তাঁর এই আবেদন শুনে রশিদি বলেন, ‘‘আনিসের বাবা শুধু ইনসাফ (বিচার) চেয়েছেন৷ সেটা দাবি করা তাঁর অধিকার। কিন্তু সবার উপরে শান্তিটা বজায় রাখতেই হবে৷ আমার মনে হয়, আনিসের বাবাও সে কথাই বলতে চেয়েছেন।’’
এ দিন ছিল আনিসের সাত দিনের পারলৌকিক কাজ (ছোলা গোনানো)। তাতে যোগ দেন কাশেম সিদ্দিকী-সহ ফুরফুরা শরিফের একাধিক পিরজাদা। পারলৌকিক কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘দোয়া’ (প্রার্থনা) আয়োজন করা হয় সারদা গ্রামের ইদগাহ ময়দানে। ওই ময়দানের কাছেই কবরস্থান। সেখানেই কবর দেওয়া হয়েছে আনিসকে। এ দিন কবরস্থান এবং ইদগাদ ময়দান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। রাতে সেখানে সিসিক্যামেরা বসানো হয় বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। আনিসের মৃতদেহ চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে পরিবারের।
পিরজাদারা আসার আগেই ইদগাহ ময়দানে চলে আসেন সালেম। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে হাজির হন বহু গ্রামবাসী। তাঁদের অনেকের হাতে ‘আনিসের খুনের ঘটনার বিচার চাই’, ‘আসল দোষীদের গ্রেফতার করতে হবে’— এই সব আবেদন সংবলিত পোস্টার ছিল।
‘দোয়া’ হয় কাশেম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে। তার আগে ওই পিরজাদা সালেমকে পাশে বসিয়ে বলেন, ‘‘আনিসের খুনের ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু ওদের দিয়ে যারা খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা শাসক দলের তাবড় নেতা এবং পুলিশের মাথারা আছে। তাদেরও ধরতে হবে।’’ সালেম বলেন, ‘‘সিট দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। সেই দু’জন কী বলছে? বলছে,
‘আমাদেরকে ওসি-র নির্দেশে বলির পাঁঠা তৈরি করা হয়েছে’। ওসি-র নির্দেশে যদি ওরা বলির পাঁঠা হয়, তা হলে চার জন তো ছিল। বাকি দু’জনকেও ধরা হোক। তাদের বক্তব্যও শোনা হোক। কিন্তু শুধু তো ওসি নয়, ওসি-র বাপও থাকতে পারে। তার উপর মহলের নেতৃত্বও থাকতে পারে। সে জন্য আমার চাই সিবিআই তদন্ত। না হলে ছেলের খুনের ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না। অন্যায়কারীদেরও শাস্তি হবে না।’’
‘দোয়া’র পরেই ছিল আমতা থানায় বিক্ষোভ কর্মসূচি। সকলে মিছিল করে সেখানে যান। গোলমালের আশঙ্কায় থানা চত্বর মুড়ে ফেলা হয়েছিল নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। হাজির ছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) শিসরাম ঝাঝোরিয়া ও হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশের পদস্থ কর্তারা।
সালেমের আবেদনে বিক্ষোভকারীরা শান্ত হওয়ার পরে ছ’জনের একটি প্রতিনিধি দল থানায় গিয়ে স্মারকলিপি দেয়। সেই দলে সালেম ছাড়াও ছিলেন পিরজাদা কাশেম সিদ্দিকী, আমতার প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্রও। গত বছর বিধানসভা নির্বাচনে আইএসএফ (ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট) নেতা হিসেবে আনিস তাঁর জন্য কাজ করেছিলেন বলে আগেই জানিয়েছিলেন অসিতবাবু।
কাশেম জানান, এ দিন বিক্ষোভে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে এলেও রাজনীতির কোনও রং লাগানো হয়নি। এমনকি, তৃণমূলেও যদি ভাল মানুষ থাকেন, তাঁরা আসতে পারেন বলে তাঁর আবেদন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সবার দাবি একটাই। আনিসের খুনের ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের আড়াল করা যাবে না। আমতা থানার ওসিকে গ্রেফতার করতে হবে। একই সঙ্গে গ্রেফতার করতে হবে যারা পুলিশকে ব্যবহার করে আনিসকে খুন করিয়েছে তাদেরও। আমাদের দাবি রবিবারে মধ্যে মানা না হলে ওই দিন আমরা গ্রামীণ জেলা পুলিশ সুপারের অফিস ঘেরাও করব। তাতেও কাজ না হলে নবান্ন ঘেরাও করব।’’
ওসি-কে গ্রেফতারের দাবিতে সন্ধ্যায় এসএফআইও আমতা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায়। তার আগে বিকেলে তারা প্রায় দু’ঘণ্টা আমতার কলতলা মোড় অবরোধ করে।