রায়গঞ্জ কলেজে ফের নৈরাজ্য

শিক্ষাঙ্গনে বহিরাগতদের প্রবেশ রুখতে শিক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারিই সার। ফের কলেজ চত্বরে সংঘর্ষে জড়াল ছাত্র ও বহিরাগতেরা। শনিবার দুপুরে রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি চলার সময়ে গেটের বাইরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে টিএমসিপি এবং এসএফআই সমর্থকেরা। হিঙ্গলগঞ্জ কলেজে আবার রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান চলাকালীন টিএমসিপি-রই দু’টি গোষ্ঠী গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৪ ০২:০৭
Share:

শুশ্রূষা চলছে এসএফআই কর্মী সায়শ্রী ভৌমিকের। ছবি: তরুণ দেবনাথ

শিক্ষাঙ্গনে বহিরাগতদের প্রবেশ রুখতে শিক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারিই সার। ফের কলেজ চত্বরে সংঘর্ষে জড়াল ছাত্র ও বহিরাগতেরা।

Advertisement

শনিবার দুপুরে রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি চলার সময়ে গেটের বাইরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে টিএমসিপি এবং এসএফআই সমর্থকেরা। হিঙ্গলগঞ্জ কলেজে আবার রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান চলাকালীন টিএমসিপি-রই দু’টি গোষ্ঠী গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। দু’টি ঘটনাতেই হামলার পুরোভাগে বহিরাগতদের দেখা গিয়েছে। রায়গঞ্জে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে জলকামান ব্যবহার করতে হয়।

ঘটনাচক্রে, রায়গঞ্জে গোলমাল বাধার আধঘণ্টা আগেই বর্ধমান রাজ কলেজে গিয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কলেজে টাকা চাওয়া হচ্ছে, উচ্ছৃঙ্খলা করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ পেলে আমি কিন্তু আইনানুগ পদক্ষেপ করত বলব। অভিযোগ প্রমাণ হলে ছাত্রনেতা জেলেও যাবেন।” রায়গঞ্জ কলেজের সামনে গণ্ডগোলে চলাকালীন অবশ্য শুধু ছাত্র নয়, তৃণমূলের রায়গঞ্জ ব্লক সভাপতি রজত ঘোষকেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু পরে ওই গোলমাল প্রসঙ্গে পার্থবাবু উল্টে বলেন, “রাজ্যের ৮৫৬টি কলেজের মধ্যে একটিতে গোলমাল হয়েছে বলে এত লাফালাফি করার কী আছে?”

Advertisement

উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ এর আগে কলেজের মধ্যেই শাসকদলের নেতাদের হাতে অধ্যক্ষের প্রহৃত হওয়ার ঘটনা দেখেছে। গত বৃহস্পতিবারই সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হতে আসা ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল এসএফআই এবং টিএমসিপি। এ দিন বেলা ১১টা থেকে দু’পক্ষ কলেজের গেটের সামনে জমায়েত হয়। এসএফআই সমর্থকেরা একটি পেট্রোল পাম্প চত্বরে জড়ো হয়েছিল। দুপুর দেড়টা নাগাদ পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে টিএমসিপি সমর্থকেরা সেখানে গেলে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশের সামনেই চলতে থাকে ইটবৃষ্টিও। অবস্থা সামাল দিতে পুলিশ প্রথমে লাঠি চালায়, পরে জলকামান থেকে জল ছুড়তে থাকে।

গণ্ডগোলে এসএফআই পরিচালিত ছাত্র সংসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক সায়শ্রী ভৌমিক এবং সংগঠনের জেলা সম্পাদক তথা কলেজের শিক্ষক প্রাণেশ সরকার আহত হন। চোট পান টিএমসিপি-র জেলা সভাপতি অজয় সরকার ছাড়াও আরও কয়েক জন ছাত্র। ইটে জখম হন রায়গঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর সুশান্ত বৈষ্ণব এবং জেলা পুলিশ লাইনের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর নীহার দাসও। সকলকেই রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। রায়গঞ্জের (সদর) ডিএসপি শুভেন্দু মণ্ডল জানান, কলেজে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। তবে কোনও পক্ষই পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেনি।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক গৌরব সাহার অভিযোগ, “তৃণমূলের রজত ঘোষের নেতৃত্বে বহিরাগতরা হামলা চালায়। প্রাণেশবাবু ও সায়শ্রীকে মাটিতে ফেলে পেটানো হয়। আমাদের কোনও সমর্থক হামলা করেনি।” অজয় সরকারের দাবি, “বৃহস্পতিবার এসএফআইয়ের দুষ্কৃতীরা তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অজিত দাসকে মেরে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। এ দিন তাই সাধারণ পড়ুয়ারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।” রজত ঘোষ ওখানে গিয়েছিলেন কেন? টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডার দাবি, “এসএফআই গোলমাল করছে শুনে আমাদের লোকেরা থামাতে গিয়েছিল।” রজতবাবুর দাবি, টিএমসিপি সমর্থকেরা যাতে সংঘর্ষে জড়ায়, তা দেখতেই তিনি সেখানে যান। আর বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের শিক্ষক প্রাণেশের বক্তব্য, “আমাদের ছেলেদের উপরে আক্রমণ হতে পারে খবর পেয়েই গিয়েছিলাম।”

উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ কলেজে আবার ফোন করে বহিরাগতদের ডেকে এনেছিলেন কিছু ছাত্রই। কলেজ সূত্রের খবর, রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানের সময় কয়েক জন ছাত্রকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে তাঁদের মঞ্চের পাশে ডাকেন টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাকেশ অধিকারী। তা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তখনই টিএমসিপি সমর্থকদের একাংশ ফোন করে বাইরে থেকে লোক ডাকেন বলে অভিযোগ। এর পরেই বহিরাগত কিছু যুবক লাঠিসোটা নিয়ে কলেজে ঢুকে পড়ুয়াদের মারধর করতে শুরু করে। পুলিশ ও বিএসএফ গিয়ে অবস্থা সামাল দেয়। স্থানীয় তৃণমূল নেতা সুশান্ত ঘোষ, আমিরুল গাজিদের অভিযোগ, সদ্য সিপিএম থেকে দলে আসা লোকজন পুলিশের সামনেই রাকেশ-সহ বেশ কয়েক জনকে মারধর করেছে। আলমগির শেখ নামে এক ছাত্র হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক দেবজ্যোতি দাসের দাবি, “মারামারি করে কলেজ ক্যাম্পাস দখলের খেলায় মেতেছে টিএমসিপি। আর উল্টে আমাদেরই ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।” শঙ্কুদেব অবশ্য পাল্টা বলেন, “এসএফআই শিক্ষামন্ত্রীর কোনও কথাই কানে নিচ্ছে না। গোলমাল করেই যাচ্ছে।” শিক্ষামন্ত্রীর বার্তা কি ছাত্র সংগঠনগুলির কানে পৌঁছচ্ছে না? বাম জমানায় শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য প্রসঙ্গ তুলে পার্থবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “৩৪ বছরের রক্ত কি আমি এক সঙ্গে বের করে দিতে পারব?” তাঁর হুঁশিয়ারি, “কলেজের মধ্যে শিক্ষক ও ছাত্ররা শুধু মানছি না, মানব না করে যাবেন, সেটা চলতে পারে না।”

অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হলে বিভিন্ন কলেজে সাম্প্রতিক গোলমালের অনেকটাই যে এড়িয়ে যাওয়া যেত, সেই কথা ইতিমধ্যেই বারবার উঠেছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “যে সমস্ত কলেজে পরিকাঠামো নেই, সেখানে অনলাইনে ভর্তি করতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তো এই পরিকাঠামো ছিল। সামনের বছর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কলেজেই যেন অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।” সুরেন্দ্রনাথ কলেজ কর্তৃপক্ষ জানান, পরিকাঠামো না থাকাতেই তাঁরা অনলাইনে ভর্তি চালু করতে পারেননি। শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস, “আমরা গোটা রাজ্যেই অনলাইনে ভর্তি চালু করার চেষ্টা করছি।”

সম্প্রতি নদিয়ার ভক্তবালা বিএড কলেজ থেকে শুরু করে বেশ কিছু জায়গায় টিএমসিপি নেতাদের বিরুদ্ধেই কলেজে ভর্তির জন্য টাকা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষামন্ত্রীও এ দিন আক্ষেপ করেন, “আগে কলেজগুলি ‘প্লেস অব লার্নিং’ ছিল। এখন তা ‘প্লেস অব আর্নিং’ হয়ে উঠেছে।” তবে এ রকম অভিযোগ সামনে এলে যে কাউকেই রেয়াত করা হবে না, তা-ও তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement