পৃথক রাজ্য চাই, হাল ছাড়তে নারাজ অনন্ত মহারাজ। নিজস্ব চিত্র।
মুখে তাঁর দাবি মতো পৃথক রাজ্য হবেই বলে চলেছেন বটে। কিন্তু তিনি কি মনে মনে হতাশ? ইদানীং রাজার আচরণে সেটা ধরা পড়লেও বেশি করে স্পষ্ট হল আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে। ‘মহারাজা’ অনন্ত রায়। নিজেকে ‘রাজা’ ঘোষণা করা ছাড়াও কোচবিহারে রাজবাড়ি বানিয়েছেন পৃথক রাজ্যের এই দাবিদার। সেই রাজার সঙ্গে দেখা ও কথা হল রাজদরবারে নয়। শিলিগুড়ির রাজপথে। রবিবার ‘রাজা’ শিলিগুড়ি এসেছিলেন বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা সুনীল বনশলের সঙ্গে দেখা করতে। সেই দেখায় কতটা নিজের কথা বলতে পেরেছেন, কতটা আশ্বাস পেয়েছেন, তা অবশ্য বেরিয়ে আসার সময় মুখচোখ দেখে ঠাহর করা গেল না। বরং একটু যেন হতাশই। শুধু বললেন, ‘‘সিদ্ধান্ত কিছু হয়নি। তবে আমি যা বলেছি তা-ই হবে। ফিল্ডে দেখা যাবে।’’ বিজেপি সূত্রে খবর, ওই বৈঠকে বনশল শুধুই শুনেছেন। শুধু বলেছেন, তিনি সবটাই এই প্রথম শুনলেন। বাংলার ইতিহাস, ভূগোল তাঁর অজানা। জানা গিয়েছে, উচ্চ নেতৃত্বকে জানানোর কাজটাই তিনি শুধু করতে পারবেন বলে অনন্তকে কথা দিয়েছেন বনশল।
অনন্তর সঙ্গে একান্তে আনন্দবাজার অনলাইনের কথা কোথায় হবে, সেটা তিনিই ঠিক করেছিলেন। কথামতো সেবক রোডের ধারে তাঁর গাড়িতে বসে কথা হল রবিবার সন্ধ্যায়। তখনও বনশলের সঙ্গে বৈঠক হয়নি অনন্তর। শিলিগুড়ি এসে পৌঁছননি বনশলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার কথা-দেওয়া কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক। আগে আগেই এসে গিয়েছেন ‘রাজা’। তবে কি এখন তাঁর তাগিদই বেশি? সেই ‘গুরুত্ব’ এখন আর তাঁকে দিচ্ছে না বিজেপি?
সুনীল বনশলের সঙ্গে বৈঠক করে আশার আলো দেখতে পেলেন কি! নিজস্ব চিত্র।
অথচ এক বছর আগের ছবি অন্য রকম ছিল। তখন নানা মামলায় অভিযুক্ত অনন্ত গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গে থাকতে পারতেন না। অসমে ছিল তাঁর গোপন আস্তানা। ২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা ভোটের আগে অনন্তের সঙ্গে বৈঠক করতে সেই আস্তানায় গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তখন অমিতের দরকার ছিল অনন্তকে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে কোচবিহারের রাসমেলা ময়দান ভরে গিয়েছিল রাজবংশী সমাগমে। বাংলায় আশা পূরণ না হলেও রাজবংশী ভোটের বড় অংশ যে বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছিল, সেটা পরিসংখ্যান বলে দেয়। ভোটের এক বছর পরে অনন্তর সঙ্গে শাহের আরও এক বার কথা হয়েছিল। গত মে মাসে শিলিগুড়ির অদূরে সুকনার নিউ চামটায় এক বেসরকারি হোটেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রধান অনন্ত। সে দিনও আশ্বাসবাণী মেলেনি। অনন্তর দাবি মতো, কথা থাকলেও দিল্লির ডাক আসেনি। এখন শাহের ‘ডেপুটি’ নিশীথের সঙ্গে দেখা করতে ‘রাজা’কেই যেতে হয় মন্ত্রীর বাড়িতে! বিজেপির প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলেই কি?
প্রশ্ন শুনে অনন্ত কিছুটা রেগেই গেলেন। বললেন, ‘‘আমি রাজনীতি বুঝি না। আমি খালি চাই, আমাদের রাজবংশীদের ঐতিহাসিক দাবি পূরণ হোক। বছরের পর বছর যে দাবি ভারত সরকার মেটায়নি। এখনও সময় রয়েছে। পর্যাপ্ত উন্নয়নের জন্য আমাদের আলাদা রাজ্য দিতেই হবে।’’ তিনি তো বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন? রাজা বললেন, ‘‘মোটেও না। আমি সরকারের পক্ষে। আমাদের দাবি মেটাতে পারবে শুধু কেন্দ্রীয় সরকার। তাই যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলি। সেই কারণেই বিজেপি। অতীতে অন্য দলের সঙ্গেও কথা বলেছি। এখন বলছি। ভবিষ্যতেও বলব।’’ কী কথা দিয়েছিলেন শাহ? এড়িয়ে গেলেন জবাব। বললেন, ‘‘সেটা আপনাকে বলা যাবে না।’’
রবিবার শিলিগুড়িতে সৌজন্য বিনিময়। তবে অনন্তের দাবিতে সহমত নন সুকান্ত। নিজস্ব চিত্র।
রাজা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলার কথা বললেও তিনি যে এখন অন্য রাজনৈতিক সমর্থন খুঁজছেন, সে ইঙ্গিতও মিলছে। ইদানীং তাঁকে তৃণমূলের সঙ্গেও দেখা যাচ্ছে। কিছু দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজয়া সম্মিলনীর মঞ্চে দেখা গিয়েছে অনন্তকে। তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেও প্রশ্ন ওঠে। অনন্তের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে সব থেকে ভাল সম্পর্ক প্রাক্তন মন্ত্ৰী তথা কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষের। তিনি মমতার সঙ্গে এক মঞ্চে থাকা নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘অনন্ত মহারাজ কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মোটেই যুক্ত নন। সব কিছুর মধ্যেই রাজনীতি মিশিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। দু’জন মানুষের মধ্যে ভাল সম্পর্ক থাকতেই পারে।’’ তৃণমূল নেতারা এমনও বলেন যে, অনন্ত মহারাজ মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলেন। দিদি হিসাবে তাঁকে শ্রদ্ধাও করেন। তবে তৃণমূলের একাংশ এমনও মনে করে যে, অনন্তের সঙ্গে দলের এমন সম্পর্ক থাকায় বিজেপির ‘ইন্ধন’ থাকা সত্ত্বেও অনন্ত আলাদা রাজ্য নিয়ে বড় কোনও আন্দোলনে যাচ্ছেন না। অনন্তের হাতে যে একটি বড় ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে তা-ও অস্বীকার করার উপায় নেই। যা এত দিন পুরোপুরি বিজেপির হাতে ছিল। এখন কি তা তৃণমূলের দিকে চলে আসবে?
‘রাজা’কে এই প্রশ্ন করতেই তিনি সোজা ব্যাটে খেললেন, ‘‘কে কাকে ভোট দেবেন সেটা আমি ঠিক করি না। কিন্তু আমার প্রজারা তো দেখছেন কে কী করছে! আমি তো মন্ত্রী-সান্ত্রী কিছু হতে চাই না।’’ কিন্তু ভাইফোঁটায় তো মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে উপহার পাঠিয়েছিলেন। সে সব দিতে এসে কোনও কথা হল? অনন্ত বললেন, ‘‘কী আবার কথা হবে? ওঁরা জানতে চাইছিলেন, কী কী উন্নয়নমূলক কাজ করা যায়! আমি আমার মতো কথা বলেছি। কিন্তু সে সব তো আমার দাবি নয়। আমরা চাই পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। সেটা তো রাজ্য সরকার দিতে পারবে না।’’ তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহার নিয়ে কিছু কথা হয়েছে? কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ‘রাজা’। তার পরে বললেন, ‘‘আইনের লড়াই তো চলছেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কি পথের লোক!’’ প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোচবিহারকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবি তিনি নিয়মিত শোনান। রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কিছু দিন আগেই গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতা অনন্তকে নিয়ে ফের নয়া রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত মিলেছিল। কিন্তু এখন সুকান্ত বলছেন, ‘‘বিজেপি রাজ্যভাগের পক্ষে নয়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যেমন বাংলা রেখে গিয়েছেন, তেমন বাংলাই আমরা চাই। তবে একইসঙ্গে আমরা মনে করি, উত্তরবঙ্গের পর্যাপ্ত উন্নয়ন হয়নি। কলকাতার একটা সেতু নির্মাণে যে টাকা বরাদ্দ হয়, সেটা উত্তরবঙ্গের উন্নয়নে হয় না। সেটা রাঢ়বঙ্গ, জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রেও সত্যি। বাংলায় উন্নয়ন শুধুই কলকাতাকেন্দ্রিক। তাই এমন দাবি ওঠে।’’
সুকান্তর সঙ্গে কথা, মমতার ভাইফোঁটার উপহার— এ সবের মধ্যেই গত শুক্রবার নিশীথের সঙ্গে দিনহাটায় বৈঠক করেন অনন্ত মহারাজ। প্রায় ৪৫ মিনিট বৈঠক হয়। সেখান থেকে বেরিয়েই অনন্ত বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য হওয়া সময়ের অপেক্ষা।’’ যদিও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ তাঁদের বৈঠককে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ বলেই উল্লেখ করেছিলেন। অনন্ত এখন বলছেন, ‘‘সে দিন নিশীথের বাড়িতে আমি অন্য কাজে গিয়েছিলাম।’’
তবে বিজেপি যে কথা রাখেনি, সেটা তিনি কথায় কথায় বোঝালেন। কে কী কথা দিয়েছিলেন, তা নিয়ে মুখ না খুললেও অমিত শাহ, রাজনাথ সিংহের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বললেন। বার বার দাবি করলেন, তাঁদের ন্যায্য দাবি নিয়ে নাকি সকলেই একমত। ‘রাজা’ কি দু’নৌকায় পা দিয়ে চলছেন? না কি তাঁকে নিয়ে রাজনীতির খেলা চলছে? উত্তর তৈরিই ছিল। অনন্তের ইঙ্গিতপূর্ণ জবাব, ‘‘খেলা বদলে যায়। খেলা শেষও হয়ে যায়।’’ এটা কি বিজেপির উদ্দেশে বলছেন? রাজার কথা ফের ইঙ্গিতপূর্ণ। বললেন, ‘‘২০২৪ সালেই তো শেষ হয়ে যাবে। তার পরে তো আবার জন্ম!’’
আর সময় ছিল না। কেন্দ্রেয়ী সরকারের কাছে বার্তা পাঠানো জন্য বনশলের সঙ্গে বৈঠকের সময় হয়ে এসেছিল। সামনে পঞ্চায়েত ভোট এবং তার পরেই লোকসভা নির্বাচনের আগে নিজেকে আরও একবার ‘গুরুত্বপূর্ণ’ করে তোলার উদ্যোগ। খুব কিছু হল কি? কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন নিয়ে সিদ্ধান্ত কি পাকা? রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ‘রাজা’ প্রকাশ্যে বললেন, ‘‘আমি তো কখনও বলিনি সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। তবে যা বলেছি তা-ই হবে। ফিল্ডে দেখা যাবে।’’
রাজার এ হেন অবস্থায় তাঁর সঙ্গীরাও খুশি নন। সঙ্গে থাকা রাজবংশী যুবক বলছিলেন, ‘‘আমাদের মহারাজা সবারে দেন মান। কিন্তু সে মান আপনি ফিরে পান না।’’