(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অমিত শাহ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
লোকসভা ভোট মিটে যেতে না যেতেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদলের আনাগোনা শুরু হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে। সব পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে আগামী ২৩ জুন কলকাতায় আসছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এক প্রতিনিধিদল। জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ অর্থ কী ভাবে খরচ হয়েছে, তা বিস্তারিত জানতে চাইবে ওই দলটি। এমনটাই খবর নবান্ন সূত্রের।
বামফ্রন্ট জমানার শেষের দিকে জঙ্গলমহলে মাওবাদী দমনের জন্য শুরু হয়েছিল ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। সেই অভিযানের জন্য তৎকালীন মনমোহন সিংহ সরকার অর্থ বরাদ্দ করা শুরু করে। বামফ্রন্ট জমানার বদলের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে মাওবাদী উপদ্রব একেবারেই কমে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও যৌথবাহিনীর একটি অংশ রয়ে গিয়েছে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জেলায়। যার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে এখনও অর্থ বরাদ্দ করতে হয়। গোড়ার দিকে যে পরিমাণ বরাদ্দ এই খাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক করত, তা বর্তমানে অনেকটাই কমে গিয়েছে। এ বার সেই বরাদ্দ কোন পথে এবং কী ভাবে খরচ হয়েছে, তা জানতেই প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে অমিত শাহের মন্ত্রক।
২৩ থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কাজ করবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিনিধিদল। তবে তাদের কাজের ধরন কী হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই নবান্নের। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক প্রতিনিধিদলটি পাঠাচ্ছে বরাদ্দ অর্থ খরচের সমীক্ষা করতে। যদিও রাজ্য প্রশাসনের একটি অংশের দাবি, বরাদ্দ অর্থ খরচ সংক্রান্ত তথ্য, সমস্ত নথি এবং ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ যথাসময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও কেন এই প্রতিনিধিদলের আগমন, তা বোধগম্য হচ্ছে না, রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের। সেই কারণেই এর মধ্যে অতীতের মতোই রাজ্যে ‘চাপে’ রাখার ‘রাজনীতি’ আছে কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে।
লোকসভা ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর অনেকে ধারণা ছিল, বিগত ১০ বছরে ধরে চলে আসা রাজনীতির ‘ধরন’ বদলে ফেলবে বিজেপি। কিন্তু মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের পরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিনিধিদল বাংলায় পাঠানো নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। তা হলে কি পুরনো পথে হেঁটেই আবারও কেন্দ্র-রাজ্য ‘সংঘাত’ পরিস্থিতি বহাল থাকবে? এমনই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজ্য প্রশাসন ও শাসক শিবিরের অন্দরে।
তথ্য বলছে, ২০২১ সালে মমতা সরকার তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজ্যে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের যাতায়াতের ‘প্রবণতা’ বেড়েছে। ওই বছর ভোটের পর ৫ মে তৃতীয় বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন মমতা। তার পরেই ভোট পরবর্তী ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে রাজ্যে আসেন কেন্দ্রীয় বিজেপির সভাপতি জেপি নড্ডা। জুন রাজ্যে এসেছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিরা। পরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল কমিশন। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘বাংলায় আইনের শাসন নয়, শাসকের আইন চলছে’। তার আগে একই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ২০২১ সালের ১৩ মে জাতীয় তফসিলি কমিশন, ১০ জুন জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন এবং ১৫ জুন জাতীয় তফসিলি উপজাতি কমিশন প্রতিনিধিদল পাঠায় রাজ্যে। সেই সব রিপোর্ট হাতিয়ার করেই কোনও মামলায় সিবিআই, কোনও ক্ষেত্রে এনআইএ রাজ্যের শাসকদলের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। সেই সব তদন্ত এখনও চলছে। প্রায়শই জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয় শাসকদলের নেতা, সাংসদ বা বিধায়কদের। গত তিন বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা মন্ত্রকের প্রতিনিধিদলও রাজ্যে এসেই চলেছে।
শাসকদলের অনেকেই মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে এই বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল আসার পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর। প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনার নাম বদল থেকে গ্রামীণ আবাস যোজনায় প্রাপকদের তালিকায় যোগ্যেরা না থাকা নিয়ে তিনিই কেন্দ্রকে নালিশ জানিয়েছেন। গোপনে নয়, বার বার সেই নালিশের কথা কখনও প্রকাশ্যে, কখনও টুইট করে জানিয়েছেন শুভেন্দু। বিরোধী দলনেতা কেন্দ্রকে চিঠি দিয়ে এমনও দাবি করেছিলেন যে, ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’র নাম বদলে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ করা হয়েছে। অভিযোগ ছিল কেন্দ্রের ‘জলজীবন মিশন’ প্রকল্পের নামবদল নিয়েও। রাজ্যে ‘জলস্বপ্ন’ নামে প্রকল্পটি চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন শুভেন্দু। আবার ১০০ দিনের কাজে ‘ব্যাপক দুর্নীতি’ হয়েছে বলে অভিযোগ করে চিঠি লিখেছিলেন। যার জেরে এখনও ১০০ দিনের কাজের টাকা পায়নি রাজ্য। যা নিয়ে দিল্লিতে গিয়ে আন্দোলন করে এসেছেন তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, ১০০ দিনের কাজের বকেয়া অর্থ রাজ্যকে না দেওয়াতেই লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ‘ভরাডুবি’ হয়েছে বিজেপি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিনিধিদল বাংলায় আবার আনাগোনা শুরু করার পরে শাসকদলের কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা-ও দেখার।