পদে পদে এত বিভ্রাট, তবু টেট কেন

নিয়োগের বিকল্প পদ্ধতি চায় শিক্ষাবিদ মহল

আগাগোড়া বিশৃঙ্খলা। প্রশ্নপত্র হারানো থেকে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ, কিছুই বাদ নেই। সেই সঙ্গে প্রতিটি পদে দুর্নীতির আশঙ্কা। রাজ্যে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট (সংক্ষেপে টেট) ঘিরে অব্যবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবং তার ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার-নিয়ন্ত্রিত এমন একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেওয়ার যৌক্তিকতা আদৌ কি আছে?

Advertisement

সুপ্রিয় তরফদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫১
Share:

টেটে অনিয়মের প্রতিবাদে কলেজ স্কোয়ার থেকে মৌলালি পর্যন্ত মিছিল করল বামপন্থী ছাত্র যুব সংগঠন। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র

আগাগোড়া বিশৃঙ্খলা। প্রশ্নপত্র হারানো থেকে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ, কিছুই বাদ নেই। সেই সঙ্গে প্রতিটি পদে দুর্নীতির আশঙ্কা। রাজ্যে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট (সংক্ষেপে টেট) ঘিরে অব্যবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবং তার ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার-নিয়ন্ত্রিত এমন একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেওয়ার যৌক্তিকতা আদৌ কি আছে?

Advertisement

শিক্ষাবিদেরা অনেকেই মনে করছেন, এই পরীক্ষা অবিলম্বে তুলে দিয়ে তার বিকল্প খোঁজা প্রয়োজন। তাঁদের বক্তব্য, স্কুলগুলি তাদের চাহিদামতো নিয়োগ করবে। সে জন্য প্রয়োজনে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের সাহায্য নিতে পারে তারা। এর বাইরে রাজ্য কেন, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের নিয়ন্ত্রিত কোনও পরীক্ষারও প্রয়োজন নেই।

টেটের মতো কেন্দ্রীয় পরীক্ষার মাধ্যমে যে নিয়োগ করতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সেই ঘোষণা করা হয় ২০০৯ সালে। তার আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষকের পদ পূরণ হয়ে এসেছে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে— মাধ্যমিকের প্রাপ্ত নম্বর, প্রশিক্ষণ-যোগ্যতা, দশ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা ও ইন্টারভিউয়ের ভিত্তিতে। পুরো প্রক্রিয়াটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ চালালেও তখন বহু প্রাথমিক স্কুল ছিল, যারা ব্যক্তিগত ভাবে ইন্টারভিউ নিয়ে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের চাকরি দিত। শিক্ষাবিদদের মতে, নিয়োগের এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটিই যথাযথ ছিল। তার বদলে বর্তমানে যে পদ্ধতি চালু হয়েছে, তা যাবতীয় বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতির পথ খুলে দিয়েছে।

Advertisement

২০০৯-এ কেন্দ্রের ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই) ঘোষণা করেছিল, প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শি‌ক্ষকের চাকরি পেতে হলে টেট পাশ করতেই হবে। কিন্তু সেই পরীক্ষা কে নেবে, এনসিটিই তা বলে দেয়নি। বাম জমানায় টেট হয়নি। ২০১১-য় পশ্চিমবঙ্গে নতুন সরকার এসে গঠন করে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, যার মাধ্যমে গোটা পরীক্ষা-প্রক্রিয়াটির কেন্দ্রীকরণ হয়। অর্থাৎ, পরীক্ষা গ্রহণের এক্তিয়ার জেলা সংসদের হাত থেকে তুলে নিয়ে দেওয়া হয় পর্ষদকে।

শিক্ষাবিদদের অনেকের মতে, এই কেন্দ্রীকরণেই বর্তমান পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে উঠেছে। বস্তুত, জেলায় জেলায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগটা রাষ্ট্রের কাজ নয়। ‘উপর থেকে’ কোনও কেন্দ্রীয় পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হলে গোটাটাই জটিল হয়ে উঠবে। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় কিংবা রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার— সকলেই প্রায় এই বিষয়ে একমত।

নয়া ব্যবস্থায় কি সুবিধে হয়েছে? উত্তর ‘না’ এবং ‘না’! অনেকে এ-ও বলছেন, পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর থেকেও টেটের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। এত বড় মাপের পরীক্ষায় অব্যবস্থার আশঙ্কা থাকবেই। আর হয়েছেও তাই।

পশ্চিমবঙ্গে টেটের প্রথম বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল ২০১২-য়। পরীক্ষা নেওয়া হয় ২০১৩-র ৩১ মার্চ। সে দিন পরীক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ে বিবিধ দুর্ঘটনা ঘটে। আর দু’বছর বাদে, মানে চলতি বছরে টেট ঘিরে তো বিভ্রাটের অন্ত নেই! এ বছর পরীক্ষার দিন স্থির হয়েছিল ৩০ অগস্ট। জেলায় জেলায় হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাঙ্কের শাখাকে দেওয়া হয়েছিল ফর্ম বিলির দায়িত্ব। সেখান থেকে বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী ফর্ম তুলতে গেলে চরম ঝামেলা বেধে যায়। টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ মেলে বেশ কয়েকটি জেলায়। এমন কিছু অসাধু চক্রের অস্তিত্ব পর্ষদও অস্বীকার করেনি। আর পরীক্ষা শুরুর মাত্র দু’দিন আগে জানা যায়, ২৭ অগস্ট পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পথে বাস থেকে লোপাট হয়ে গিয়েছে এক প্যাকেট প্রশ্নপত্র!

শোরগোল তুঙ্গে ওঠে। প্যাকেটটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমতাবস্থায় প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে স্থির হয়, টেট হবে ৪ অক্টোবর। পরে তা আরও পিছিয়ে হয় ১১ অক্টোবর। শেষমেশ ওই দিনেই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও লেগে গিয়েছে প্রশ্ন ফাঁস ও দুর্নীতির অভিযোগের দাগ।

এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘২০০৯-এর আগে যে ভাবে নিয়োগ হয়েছে, তাতে এমন বিশৃঙ্খলা হতো না। টেটের কোনও প্রয়োজন নেই।’’ তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘এ বারের টেটে অনেকে ফর্ম পূরণ করেও পরীক্ষা দিতে যাননি। তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন, আগেই সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে!’

পবিত্রবাবুও টেট তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী। তাঁর কথায়, ‘‘এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ মারফত নিয়োগই ভাল ছিল। এই ধরনের বিশৃঙ্খলা আটকানো যেত।’’ রবীন্দ্রভারতীর আর এক প্রাক্তন উপাচার্য শুভঙ্কর চক্রবর্তীর মূল আপত্তি অবশ্য টেট প্রক্রিয়ার চরিত্র নিয়ে। তিনি চান, পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হোক জেলা সংসদগুলোকে। ‘‘টেটের বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। শিক্ষামন্ত্রী ও আমলারা পারেননি পরীক্ষাপর্ব সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে। তার পরেও কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা চালু রাখার যুক্তি কী?’’— প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

কার্যত একই মত পোষণ করে আনন্দদেববাবু জোর দিয়েছেন বিকল্প খোঁজার উপরে। তিনি বলছেন, ‘‘আমি মনে করি না, টেটের আদৌ দরকার আছে। টেট সমস্যার কথা এনসিটিই-কে জানানো উচিত। তাদের চূড়ান্ত মতামত না-আসা পর্যন্ত জেলাস্তরেই পরীক্ষা-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হোক।’’ শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যালের আক্ষেপ, ‘‘পুরো পদ্ধতির মধ্যেই গলদ! সরকারের উচিত অন্য উপায় বার করা।’’ যাদবপুরের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসুর কণ্ঠেও বিকল্পের দাবি। ‘‘টেটের পদ্ধতিতে বিস্তর ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গিয়েছে।’’— বলেন তিনি।

সাম্প্রতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে বিকল্প চেয়ে দিল্লিতে দরবার কিংবা বিকেন্দ্রীভূত পদ্ধতি চালুর কোনও ভাবনা রাজ্যের আছে কি? এই মুহূর্তে অন্তত তেমন ইঙ্গিত নেই। টেট প্রসঙ্গে মতামত জানতে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল। ওঁরা ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব আসেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement