বছরের গোড়ায় শিল্পের দাবিতে সিঙ্গুর থেকে শালবনি পদযাত্রার সূচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর স্বপ্নের শিল্প-প্রকল্পের কঙ্কাল যেখানে দাঁড়িয়ে, তার উল্টো দিকের রাস্তায় বাঁধা মঞ্চে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর পাশে সে দিন শিল্পায়নের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন বামফ্রন্টের শরিক নেতারা। একই সুরে বলেছিলেন, বামেরা ক্ষমতায় ফিরলে সিঙ্গুরে ফের কারখানার ধোঁয়া উঠবে! কিন্তু সুর কেটে দিল সুপ্রিম কোর্ট!
সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ছিল বলে সর্বোচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দিতেই সিপিএমকে ফের কাঠগড়ায় তুলে দিচ্ছেন শরিক নেতারা! বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার পরে বাম শরিকদের অবস্থা এখন শোচনীয়। সেখান থেকেই বড় শরিকের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তিক্তও হয়েছে। সিঙ্গুর মামলার রায় সেই কাটা ঘায়ে আরও নুনের ছিটে দিয়েছে!
টাটাদের প্রকল্পের জন্য সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু ফ্রন্টের সব শরিকই জমি অধিগ্রহণের দায় সিপিএমের ঘাড়েই চাপাচ্ছে। সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি নেতারা আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা আগাগোড়াই সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু বড় শরিকের গোঁয়ার্তুমিই কাল হয়েছিল!
সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক প্রবোধ পণ্ডা জানান, সিঙ্গুরে তো বটেই, তাঁর দলের কৃষক সংগঠন প্রাদেশিক কৃষক সভা ওই জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে জমায়েতও করেছিল। কিন্তু সিপিএম তখন কথা শোনেনি। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্য সরকারকে এই রায় যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ওই জমিতে যারা চাষ করতেন, সেই প্রকৃত চাষিদের স্বার্থ আগের সরকারও দেখেনি। বর্তমান সরকারও ভাবছে না।’’ সিপিএম তাঁদের আপত্তি কানে তোলেনি বলে অভিযোগ আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামীরও। তাঁর কথা, ‘‘মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়, আমি প্রতিবাদ করি। আমার কথা শোনা হয়নি। প্রতিবাদে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসি।’’
সিঙ্গুরের সঙ্গে নন্দীগ্রামের কথাও টেনে আনছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নরেন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘জমি অধিগ্রহণের নিন্দা করে সিঙ্গুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে অশোকদা (প্রয়াত অশোক ঘোষ) সভাও করেছিলেন। আমরা প্রথম থেকেই সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ফেরতের দাবি জানিয়ে আসছি।’’ প্রসঙ্গত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের নাম বদলের বহু বছর আগেই অশোকবাবু যে ফ ব-য় ‘বাংলা কমিটি’ গড়েছিলেন, তা-ও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন নরেনবাবু। আর এক শরিক আরসিপিআইয়ের নেতা মিহির বাইনের দাবি, ‘‘এই রায় শুধু কৃষকের জমিই ফিরিয়ে দিল না। সিপিএম নেতাদের মুখেও ঝামা ঘষে দিল! বামফ্রন্টকে বিভ্রান্ত করেছিলেন বুদ্ধবাবু-নিরুপমবাবু-সূর্যকান্ত মিশ্র। বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ভুল হলে সব দায় তাঁর। তাঁদের এখন উচিত, দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া!’’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবু অবশ্য বলেই দিয়েছেন, ‘‘ক্ষমা চাওয়ার বিষয় নয় এটা। আদালত মনে করেছে, সিঙ্গুরে কারখানা না হয়ে জমি পড়ে আছে, সেই জমি ফিরিয়ে দেওয়াই উচিত। আমরা ২০১১-র ভোটের পরেই বলেছিলাম, মানুষ যখন তৃণমূলের পক্ষে রায় দিয়েছেন, ওঁরা চাইলে জমি ফিরিয়ে দিতে পারেন।’’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘নন্দীগ্রামে গিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, মানুষ না চাইলে এক ছটাক জমিও নেব না। পরে পর্যালোচনা করে আমরা লিখিত ভাবেও জানিয়ে দিয়েছি, কোথাও জমি নিতে হলে মানুষের সঙ্গে কথা বলে সতর্ক হয়েই এগোতে হবে।’’
বামফ্রন্টের বাইরে এসইউসি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন এবং পিডিএস-ও সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করে আন্দোলন নেমেছিল। তারা রায়কে স্বাগতই জানিয়েছে। এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসুর কথায়, ‘‘আমরা চেয়েছিলাম, আন্দোলনের জোয়ারে অধিগৃহীত জমি দখল করে কৃষকদের হাতে তুলে দিতে। তৃণমূল নেত্রী তখন আমাদের কথা শুনলে সিঙ্গুরে জমিহারা ১২ জন কৃষককে আত্মহত্যা করতে হত না।’’ আর এঁদের সকলের চেয়ে এগিয়ে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী। টাটার যাতে অসম্মান না হয়, দেখতে হবে। মমতাকে অনুরোধ করছি, বাংলার কৃষকের স্বার্থ রেখে শিল্পকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে।’’