মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
লক্ষ্মীর ভান্ডার হোক বা কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী হোক বা রূপশ্রী— পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যাবতীয় জনমুখী প্রকল্প ধারের টাকাতেই চলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের রাজকোষের হিসেবনিকেশ খতিয়ে দেখে এ কথা জানাল কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি’ (এনআইপিএফপি)।
গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে তুরুপের তাস হিসেবে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালু করেছিল তৃণমূল সরকার। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফলের পিছনেও তা তৃণমূলের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। আরজি করের ঘটনার পরে অবশ্য অনেক মহিলাই সমাজমাধ্যমে জানান, লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আসে না বলে তাঁরা গর্বিত। অনেকে আবার এই টাকা আর নেবেন না বলেও দাবি করেছেন। বিভিন্ন রাজ্যের ভর্তুকির বহর খতিয়ে দেখে এনআইপিএফপি সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্নেহের পরশ, কর্ম সাথী, ঐক্যশ্রী, গতিধারা, মুক্তিধারা, জলধারা, কৃষক বন্ধুর মতো যে সব জনমুখী প্রকল্প চালু করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার, সেগুলির খরচ জোগানো হচ্ছে ধার করে।
এনআইপিএফপি-র রিপোর্ট
১. লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে কন্যাশ্রী-র মতো পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় জনমুখী প্রকল্প ধারের টাকায় চলছে
২. দুর্গাপুজোর সময় ক্লাবগুলিকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার খরচ বাজেটের নথিতে স্পষ্ট করে দেখানো নেই
৩. বাসের ভাড়া না বাড়ানোর জন্য পরিবহণ সংস্থাগুলির লোকসান মেটাচ্ছে রাজ্য সরকার
৪. নিজস্ব আয়ের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ অন্য রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে
৫. ঘাটতি ও দেনা কমাতে গিয়ে পরিকাঠামো তৈরিতে খরচ কমাতে হচ্ছে
এনআইপিএফপি-র রিপোর্ট বলছে, মমতা সরকার যে সব জনমুখী প্রকল্প চালু করেছে, তার পিছনে ২০১৮-’১৯ অর্থ বছরে খরচ হত ১৩৪৫ কোটি টাকা। ২০২১-’২২-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩০২ কোটি টাকা। ২০২২-’২৩-এ তা এক লাফে বেড়ে ১২,৩৪৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। একই সঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্গাপুজোর সময়ে ক্লাবগুলিকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া রাজ্য সরকারের আর একটি জনপ্রিয় প্রকল্প। কিন্তু বাজেটের নথিতে তা স্পষ্ট করে কোথাও দেখানো নেই।
দিল্লির এই সংস্থার অর্থনীতিবিদরা রিপোর্টে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে গণপরিবহণ বা বাসে যাতায়াতের খরচ দেশের মধ্যে সব থেকে কম। বাসের ভাড়া না-বাড়ানোর জন্য কলকাতা রাজ্য পরিবহণ, দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য পরিবহণ, উত্তরবঙ্গ পরিবহণ, কলকাতা ট্রাম কর্পোরেশনের মতো সংস্থাগুলির লোকসানে চলে। সেই লোকসান মেটাতে রাজ্য সরকার পরিবহণ সংস্থাগুলিকে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি জোগায়। খাদ্য, বিদ্যুৎ, পরিবহণের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পেও রাজ্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজ্যের নিজস্ব জনমুখী প্রকল্প। এই সব টাকাই আসছে ধার করে। উদাহরণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২১-’২২ অর্থ বছরে রাজ্য সরকারের ভর্তুকির বহর ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ওই বছরে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যার অর্থ ভর্তুকির সব টাকাই এসেছে ঋণের থেকে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজকোষের সামগ্রিক হাল নিয়েও এনআইপিএফপি-র রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, নিজস্ব আয়ের মাপকাঠিতে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচেষ্টায় ঘাটতি রয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্যের নিজস্ব আয় রাজ্যের জিডিপি-র ৫ শতাংশেরও কম এবং তা ক্রমশ কমছে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, পুরনো ঋণে সুদের বোঝার মতো খরচ রাজ্য সরকারের পক্ষে কাটছাঁট করা সম্ভব নয়। রাজস্ব ব্যয় লাগাতার বাড়ছে। এর ৩০ শতাংশই চলে যাচ্ছে পেনশন ও সুদের বোঝায়। আয়-ব্যয়ের ফারাক বা ঘাটতি এবং দেনার বহর কমাতে গিয়ে পরিকাঠামোর পিছনে খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অথচ পরিকাঠামোর পিছনে খরচ করলেই অর্থনীতির গতি বাড়ে।
এনআইপিএফপি-র অর্থনীতিবিদদের মতে, সকলের জন্য উন্নয়ন, সামাজিক কল্যাণ ও আঞ্চলিক বৈষম্য মেটানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হয়। কিন্তু রাজকোষের টানাটানি অবস্থা হলে এই সব ভর্তুকি নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন।