বন্যার বিক্ষোভে পড়েও ফিরলেন না সূর্য

বন্যার জল বাড়তেই ঘটনাস্থলে দৌড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ১২ দিন পরে বন্যা যখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, সেই সময়ে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হল বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ও বাম প্রতিনিধিদলকে।

Advertisement

নুরুল আবসার ও মনিরুল ইসলাম

উদয়নারায়ণপুর শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৫৬
Share:

সূর্যকান্ত মিশ্রের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ। বৃহস্পতিবার উদয়নারায়ণপুরে। ছবি: সুব্রত জানা।

বন্যার জল বাড়তেই ঘটনাস্থলে দৌড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ১২ দিন পরে বন্যা যখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, সেই সময়ে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হল বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ও বাম প্রতিনিধিদলকে।

Advertisement

কয়েকশো গ্রামবাসী, যাঁদের অধিকাংশই মহিলা, বৃহস্পতিবার উদয়নারায়ণপুরের রাজাপুর-সিংটি মোড়ে সূর্যবাবুর রাস্তা অবরোধ করেন। সেখানে স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীদেরও দেখা গিয়েছে। তবে কারও হাতে দলীয় পতাকা ছিল না। অনেকটা যে ভাবে শাসক দলের পতাকা ছা়ড়াই হাবরা-অশোকনগরে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে। প্রবল বিক্ষোভের মুখে রূপা শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, সূর্যবাবু ফেরেননি।

বিক্ষোভকারীরা এ দিন সূর্যবাবুর গাড়িতে চাপড় মারেন। কয়েক জন মহিলা জুতো খুলেও তুলে ধরেন। সূর্যবাবুর নামে ‘গো-ব্যাক’ স্লোগান চলতে থাকে। গাড়িতেই ছিলেন সূর্যবাবু। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, ‘‘এলাকা যখন ডুবে ছিল, তখন কেন আসেননি? এখন জল নামার পর সকলে যখন ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন, তখন কেন এসেছেন?’’ বিরোধী দলনেতার পিছনের গাড়িতে ছিলেন জেলার ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা জগন্নাথ ভট্টাচার্য। বিক্ষোভকারীরা সেই গাড়ির হেডলাইট ভেঙে দেন। গাড়িটি চাগিয়ে উল্টে দিতেও উদ্যত হন। প্রায় ৪৫ মিনিট এ ভাবে বিক্ষোভ চলতে থাকায় পুলিশ জগন্নাথবাবুর গাড়িটি ফিরিয়ে দেয়। সে দিকে জনতা হইহই করে ধাওয়া করলে সূর্যবাবুর গাড়ি বেরিয়ে যায়।

Advertisement

প্রত্যাশিত ভাবে এই ঘটনায় তৃণমূলের হাতই দেখছেন সূর্যবাবুরা। এমনকী, পুলিশের ভূমিকা নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু উদয়নারায়ণপুরে পরিস্থিতি যখন সঙ্গিন ছিল, তখন না গিয়ে এত পরে কেন আসরে নামলেন বাম নেতারা, সেই প্রশ্ন থাকছেই। মানুষের বিপন্নতার সময়ে সক্রিয়তা দেখাতে বিরোধীরা দেরি করে ফেলেছেন কি না, উঠছে সেই প্রশ্নও।

যদিও সূর্যবাবুর অভিযোগ, বহু মানুষ এখনও ত্রাণ পাননি। অনেকের বাড়ি এখনও জলের তলায়। অথচ তাঁদের স্কুলের শিবির ছাড়তে বলা হয়েছে। শাসক দল এই ‘সত্য গোপন’ করতেই বাম প্রতিনিধি দলের পথ আটকে বিক্ষোভ দেখিয়েছে এবং একাধিক গাড়ি ভাঙচুর করেছে বলে সূর্যবাবুর অভিযোগ। তিনি বলেন, পুলিশের তরফে বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি দেখে তিনি যেন কর্মসূচি বাতিল করে ফিরে যান। জবাবে তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, প্রয়োজনে সাইকেল চড়ে বন্যাদুর্গতদের কাছে যাবেন। কিন্তু ফিরে যাবেন না। সূর্যবাবুর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ওই রাস্তা দিয়ে গেলেও ওঁদের কথা শুনতে তো দাঁড়াননি! যারা আজ পথ আটকেছিল, তার মধ্যে দুষ্কৃতীরাও ছিল।’’ আর এক বাম বিধায়কের মন্তব্য, ‘‘জলে নেমে ছবি তোলার লোক কিন্তু সূর্যবাবু নন! ত্রাণ নিয়ে সমস্যা আছে জেনেই তিনি হাওড়ায় গিয়েছিলেন।’’

সচরাচর বিরোধী দলের কেউ বিক্ষোভের মুখে পড়লে শাসক দলের তরফে ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ’। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে কেউ কিন্তু এ দিন বিরোধী দলনেতাকে ঘিরে বিক্ষোভ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি। নবান্নে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও গুরুত্ব দিতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবে উদয়নারায়ণপুরের তৃণমূল বিধায়ক সমীর পাঁজার দাবি, ‘‘বন্যা হয়ে যাওয়ার এত দিন পরে সিপিএম নেতারা এখানে আসায় ক্ষুব্ধ বানভাসিরাই বিক্ষোভ দেখান। এর সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ হাওড়া (গ্রামীণ) জেলা পুলিশের দাবি, অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে পুলিশ তার কাজ করেছে।

বিক্ষোভের পরবর্তী ঘটনায় বামেরা অবশ্য শাসক দলের দিকেই আঙুল তোলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদে দুপুরে হাওড়ার ফাঁসিতলায় সিপিএম সমর্থকদের অবরোধ পুলিশ হটাতে গেলে দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। সিপিএমের অভিযোগ, হাওড়া পুরসভার দুই তৃণমূল মেয়র পারিষদ অবরোধে আটকে যাওয়ায় তাঁদের নির্দেশে পুলিশ দলীয় নেতা-কর্মীদের বেধড়ক মারধর করে। পুলিশ অভিযোগ মানেনি। ৮ জন বিক্ষোভকারীকে পুলিশ গ্রেফতারও করে। যাবতীয় ঘটনাপ্রবাহের জেরে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর মন্তব্য, ‘‘বন্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সর্বদল বৈঠক যে নিছক লোকদেখানো উদ্যোগ ছাড়া কিছু নয়, এ ঘটনা থেকে তা প্রমাণিত হল!’’ রাজ্য জু়ড়ে এর প্রতিবাদে ধিক্কার কর্মসূচি পালনের আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।

বৃহস্পতিবার হাওড়ায় সিপিএমের অবরোধ হটাতে গিয়ে পুলিশের
সঙ্গে হাতাহাতির মুখে দলীয় কর্মীরা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

অতিবৃষ্টি এবং ডিভিসি-র ছাড়া জলে এ বার বন্যা হয়েছে হাওড়ার আমতা এবং উদয়নারায়ণপুর ব্লকে। কয়েক দিন ধরে জল নামতে শুরু করলেও এখনও বহু মানুষ ঘরে ফিরতে পারেননি। লন্ডন সফর কাটছাঁট করে রাজ্যে ফিরে মুখ্যমন্ত্রী এই উদয়নারায়ণপুরের রাজাপুরেই পরিস্থিতি দেখতে এসেছিলেন। এত দিন রাজ্য স্তরের কোনও বাম নেতার পা পড়েনি উদয়নারায়ণপুরে। যদিও সিপিএমের হাওড়া জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার প্রশ্ন তুলেছেন, দলীয় নেতারা যে হেতু ত্রাণ নিয়ে যাননি, সে ক্ষেত্রে দেরি করে যাওয়ার প্রশ্ন কী করে ওঠে? তা ছাড়া, দেরি হলেও তাঁদের কি বন্যার্ত এলাকায় যাওয়ার অধিকার নেই?

রাজাপুরে বিক্ষোভ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচারুলের সন্তোষচক প্রাথমিক স্কুলে সরকারি ত্রাণ শিবিরে যান সূর্যবাবু। আগে থেকেই সেখানে হাজির ছিলেন সিপিএমের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। দুর্গতদের কয়েক জন বিরোধী দলনেতার কাছে অভিযোগে জানান, সামান্য কিছু চিঁড়ে ছাড়া এত দিনে কিছুই পাননি! অনেকের মাটির বাড়ি পড়ে গিয়েছে। ত্রিপল না দেওয়ার ফলে তাঁরা ঘরে ফিরতে পারছেন না। ত্রাণ বিলি নিয়ে বামেদের অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল বিধায়ক সমীরবাবু। আর কলকাতায় ফিরে সূর্যবাবুর মন্তব্য, ‘‘ওই এক জায়গা ছাড়া আর কোথাও কেউ পথ আটকায়নি। বরং, ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে মানুষ অভিযোগ করেছেন। এর পরে আমরা নবান্ন অভিযান (২৭ অগস্ট) করব। তখন আটকে দেখাক!’’

ক্ষত সারাতে ঋণ ব্যাঙ্কের

বন্যা-পরবর্তী পুনর্গঠনের কাজে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে বৈঠক করলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। বৃহস্পতিবার মধ্য কলকাতার একটি হোটেলে স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কারস কমিটির বিশেষ বৈঠকে ঠিক হয়েছে, কৃষি, উদ্যানপালন, সেচ, পানীয় জল, পশুপালন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে-ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার পুনর্নির্মাণে সহজ শর্তে ঋণ দেবে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক।

জেলা স্তরে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা এবং ঋণের সম্ভাব্য পরিমাণ ঠিক করতে ১৮ অগস্ট বৈঠকে বসবেন জেলাশাসকেরা। ২০ অগস্ট অর্থমন্ত্রী পুরো পরিস্থিতি যাচাই করে ব্যাঙ্কগুলির কর্তব্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে অর্থ দফতর সূত্রের খবর। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘এ বারের বন্যায় রাজ্যের ২৩৯টি ব্লকের ১৭ হাজার ৩৭৯টি মৌজায় এক কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১৩ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমির ফসল নষ্ট হয়েছে। বন্যা হয়েছে রাজ্যের ৫৫টি পুরসভা এলাকায়।’’ এমনকী কলকাতা পুরসভার ৫২টি ওয়ার্ডও বন্যাকবলিত বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী।

অমিতবাবুর বক্তব্য, সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি বিচার করে ২১ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর ভিত্তিতে ঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করতে পারে কেন্দ্র। কিন্তু তার বাইরেও স্থানীয় ভাবে পুনর্গঠনের কাজে ব্যাঙ্ক যাতে ঋণ এবং অন্য ভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে, সেই জন্যই তাদের নিয়ে এ দিনের বৈঠক বলে জানান অর্থমন্ত্রী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement